চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

দৈনন্দিন জীবনে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন

এএইচএম মনিরুল কাদের

১৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব এখন অনেক এগিয়ে গেছে তথ্য ও প্রযুক্তি দিয়ে। পুরো পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় এসেছে তথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। মানুষ এখন নিমিষেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ করতে পারছে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে। মানবজাতি দিন দিন উন্নত থেকে উন্নত হচ্ছে তথ্য ও প্রযুক্তির আর্শীবাদে। তথ্য প্রযুক্তির একটি অন্যতম খাত হচ্ছে সাইবার জগত যোগাযোগের মাধ্যমকে এটি একটি ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এখন মুহূর্তেই ভিডিও কল, ম্যাসেজিং, ই-মেইল দিয়ে সবই সমাধান হয় সাইবার জগতে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বাংলাদেশও এগিয়ে চলছে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে ও আন্তরিকতায় ইন্টারনেটে হয়েছে সহজলভ্য ও হাতে হাতে সেবা প্রদান করে চলছে। এই ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার সময়ে বাংলাদেশের জনগণ যেমন উপকার পাচ্ছে, তেমনি কিছু অসৎ ব্যক্তি এর অপব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত করছে। সাইবার জগতে এই অপরাধ রুখতে সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ পাস করেছিল।

এই তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ পাস করার পর সাইবার অপরাধ দমনে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকেরই এই তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ব্যাপারে সঠিক ধারনা নেই। আমি সাইবার অপরাধ দমনে তথ্য প্রযুক্তি আইনের চুম্বকীয় অংশ তুলে ধরলাম। বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম দমনে “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬” আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। পরবর্তীত ২০০৯ ও ২০১৩ সালে এই আইনে কিছু সংশোধন করা হয়। তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৬ ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই ধারায় বলা হয়েছে- * যদি কোন ব্যক্তি জনসাধারণের বা কোন ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হইবে এই মর্মে অবগত হওয়া স্বত্বেও এমন কোন কাজ করেন, যার ফলে কম্পিউটার রিসোর্সের কোন তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরবর্তীত হয় বা তার মূল্য বা উপযোগীতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনভাবে একে ক্ষতিগ্রস্ত করে। * এমন কোন কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রিক সিস্টেম অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করেন যাতে তিনি মালিক বা দখলকার নন, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ। কোন ব্যক্তি হ্যাকিং অপরাধ করলে তিনি অনুর্ধ্ব ১০ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। এক কোটি টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারায় উল্লেখিত আছে, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করে ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেকট্রিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও বানোয়াট বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী দেওয়া হয়। তাহলে এই কাজ অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। কোন ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। [যদিও ইহা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ তে সংশোধিত হয়েছে]

তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৬৮ ধারায় বলায় হয়েছে, সরকার সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচারের উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। গঠিত সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শ করে সরকার একজন দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজকে মামলা পরিচালনার দায়িত্বে দিবেন এই ট্রাইব্যুনাল ‘সাইবার ট্রাইব্যুনাল’ নামে অভিহিত হবে। উক্ত ট্রাইব্যুনাল তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর আইনের অধীন অপরাধসমূহের বিচার করবেন।

তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৭৪ ধারায় আনীত, ফৌজদারী কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ উদ্দেশ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত এই আইনের অধীনে দায়রা জজ আদালত বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সরকার গেজেট, প্রজ্ঞাপন দিয়ে এক বা একাধিক সাইবার আপীল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। সাইবার আপীল ট্রাইব্যুনাল অধীন সাইবার ট্রাইব্যুনাল বা দায়রা আদালত ঘোষিত রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে আপীল শুনবে ও নিষ্পত্তি করবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০০৯ এর ৮ম অধ্যায়ে ধারা ৫৪-৮৪ তে কম্পিউটার সম্পর্কিত অপরাধ, তদন্ত বিচার ও দন্ড ইত্যাদি বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এই আইনের ৭৬ নং ধারা অনুসারে অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা- ক) ফৌজদারী কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, নিয়ন্ত্রক বা নিয়ন্ত্রক হতে এ উদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা বা সাব ইন্সপেক্টরের পদমর্যাদা নয় এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তা এই আইনের অধীনে অপরাধ তদন্ত করবেন। খ) এই আইনের অপরাধ সমূহ অ-আমলযোগ্য হবে। এ আইনের সঠিক উপস্থাপনা ও আইনের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা অপরিহর্য্য। যা সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

* তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধিত) আইন ২০১৩, আপনি যদি অন্য কারো কম্পিউটারে তার অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন তাহলে আপনার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। শুধু তাই নয় এই অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় আপনি জামিন নাও পেতে পারেন। তদুপরি বিনা পরোয়ানায় পুলিশ আপনাকে গ্রেফতারও করতে পারবে।

বিশ্বে প্রথম ইংল্যান্ড সাইবার আইন প্রণেতা হিসেবে কম্পিউটার মিসইউজ অ্যাক্ট ১৯৯০ তৈরী করে। ই-ক্রাইম প্রতিরোধে ২০০৮ সালে জাতীয় ই-ক্রাইম ইউনিট ও গঠন করা হয়। ভারতেও প্রণীত আছে তাদের তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০০। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন তৈরী হয় এবং পরে তা সংশোধনও করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি আরো একটি আইন করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। বাংলাদেশ সরকার ও ইন্টারনেট এর সুফল্ যাতে সবাই পায় এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে সাইবার অপরাধও দিন দিন বাড়ছে। অনেকে না জেনে না বুঝে অপরাধ সংগঠিত করছে। কারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বেশীরভাগেরই তথ্য প্রযুক্তি আইন সম্পর্কে কোন ধারনা নেই। তাই আমাদের শিক্ষিত নাগরিকদের উচিৎ সামাজিক ও পারিবারিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে এই আইন সচেতনতা বৃদ্ধি করা, এর প্রয়োগ সম্পর্কে সকলকে জ্ঞাত করা, তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের জীবন অভিশাপ নয়, আর্শীবাদ হয়ে থাকুক এই চাওয়া আমাদের সর্বদা।

এএইচএম মনিরুল কাদের এড্ভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট