চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সৎ জীবনের দিশারী মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী

১৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ঘাম ঝরানো পরিশ্রম, নির্লোভ ও নির্মোহ জীবন এবং নীরবে জ্ঞান বিতরণ- এমন এক মহৎ জীবনের অনন্য উদাহরণ মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী। শিক্ষক, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং জুরী বোর্ডের সদস্য হিসেবে বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মযজ্ঞে ভরা তাঁর জীবন। গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন, পায়ে হেটে মাইলের পর মাইল মেঠোপথ পাড়ি দিয়েছেন। জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন, অপরাধ দমন করেছেন, বিচার-শালিশ করেছেন, কৃষিখামার গড়েছেন। হাতপাখায় শরীর জুড়ানো, লেবুপাতার শরবতে তৃষ্ণা নিবারণ, কাঠের চৌকিতে শয়ন, শাকসবজী দিয়ে আহার, অতি সাধারণ বেশভূষা, এ ছিল তাঁর নৈমিত্তিক জীবনচর্চা। অর্থ উপার্জনের নেশা বা বিলাসী জীবনের মায়া তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি। চট্টগ্রামের রাউজান আরআরএসি ইনস্টিটিউশান শিক্ষার মানে অদ্বিতীয় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে তাঁর শিক্ষকতার সুনাম ছড়িয়ে ছিল দেশজুড়ে।

কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের গ্র্যাজুয়েট, ইংরেজি ও ভূগোলে পান্ডিত্য, শৃংখলা ও শাসনের কঠোর দন্ড- এসবের সমন্বয়ে তিনি এক কিংবদন্তীর ব্যক্তিত্ব। তাঁকে বলা হতো ‘ভূগোলের পন্ডিত’ ও ‘ভূগোল শিক্ষার জাদুকর’। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে স্থাপিত পৃথিবীর মানচিত্রটি চাক্ষুষ না দেখেই চেয়ারে বসে পেছন থেকে লাঠি ঘুরিয়ে তিনি পৃথিবীর দেশগুলো নির্ভূলভাবে চিহ্নিত করে ভূগোল শেখাতেন। অথচ এ যুগের শিক্ষা-শিখন প্রক্রিয়া হলো বই পড়ে মুখস্থ নির্ভরতা।

মাস্টার রুহল আমীন চৌধুরীর বহু ছাত্র বাংলাদেশের প্রশাসন, প্রকৌশল, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন। রুহুল আমীন স্যারের কড়া অনুশাসনে এ প্রতিষ্ঠান খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল। বাংলা,উর্দু ও ইংরেজিতে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। দীর্ঘ ৩৪ বছর তাঁর জীবন উৎসর্গিত হয় শিক্ষকতায়। অর্থনৈতিক লাভালাভ না ভেবে ১৯২৯ সনে মাত্র ৭০ টাকা বেতনে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা। এরপর সহকারি প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর গ্রহণ। সরকারি চাকুরির প্রলোভন, শহরে জীবনযাপন কিংবা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার আকর্ষণ তাঁর ছিল না। তিনি দীর্ঘ ৩২ বছর প্রচ- জনপ্রিয়তা নিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন কঠোর। চোর-ডাকাত ও

বন্যজন্তুর কবল থেকে মুক্ত করেছেন প্রকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত হলদিয়াকে।
দুর্দমনীয় সাহসে অনেক দুর্ধর্ষ ডাকাত ও অপরাধীকে ধরে বিচারে সোপর্দ করেন। এলাকাজুড়ে ফিরে আসে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা। তাঁর ন্যায়পরায়নতায় মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকার জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে রুহুল আমীন চৌধুরীকে নিয়োগ প্রদান করে। এখানে বিচারকের আসনে বসে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। অপরাধ দমনে সাফল্য ও ন্যায়বিচারে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে অভিনন্দন বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। ১৯২৭ সনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ‘জনসেবা ও সুশাসনের’ স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে সনদপত্র, ঘড়ি ও সোনার আংটি উপহার দেয়া হয়।

৬০-৭০ এর দশক। গ্রামে গ্রামে সুপেয় পানির সংকট। পুকুর-দীঘির পানি ছিল একমাত্র সম্বল। উদার চিত্তে এগিয়ে আসেন রুহুল আমীন চৌধুরী। স্থাপন করেন গভীর নলকূপ। সুমিস্ট পানির অবিশ্রান্ত শ্রোতধারায় গ্রামবাসীদের প্রাণ ভরে গেল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এক কলসী পানির জন্য ছুটে আসতো। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হয় ইয়াসীননগর জুবিলী প্রাথমিক বিদ্যালয়, জানিপাতার বিদ্যালয়, ইয়াসীন নগর জুবিলী ঈদগাহ মাঠ। এছাড়া বিশাল এলাকা তিনি ওয়াকফ করেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁর নামফলক বসাননি। কখনো জনসভা ডেকে বক্তৃতায় প্রকম্পিত করেননি।

নীরবে-নিভৃতে মেধা ও শ্রম দিয়েছেন। পিতার অকাল মৃত্যু হলে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ করে নেন সহোদর ভাই যথাক্রমে বজলর রহমান চৌধুরী, বদিউল আলম চৌধুরী, ফজলুল হক এবং নজমুল হককে। পরম যতেœ এবং ¯েœহের বন্ধনে তাঁদের গড়ে তুলেন। তাঁদের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করেন। তাঁরাও তাঁকে পিতৃতুল্য সম্মানে অধিষ্ঠিত রাখেন। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাউজানে হিন্দুসম্প্রদায় এবং স্থানীয় পাহাড়ী এলাকার উপজাতি জুম্মসম্প্রদায় মাস্টার রুহুল আমিনকে শ্রদ্ধাভরে তাদের অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন। বিশেষ করে জুম্মসম্প্রদায় প্রতিবছর কুরবানীর ঈদে তাঁর বাড়ীতে এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করে ধন্য হতো। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর টার্গেট ছিল রাউজান। বিশেষ করে সংখ্যালঘু গ্রামে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ কঠিন সংকটে ডাবুয়া গ্রামের প্রসিদ্ধ হিন্দুজমিদার ‘ধর’ পরিবারকে তিনি নিজ বাড়ীতে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাস এ দুটি পরিবার রুহুল আমীন চৌধুরীর বাড়ীতেই অবস্থান করেছিল।

রুহুল আমীন চৌধুরীর পিতা ছিলেন ভারতের দেওবন্দ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীপ্রাপ্ত মৌলভী আব্দুর রহমান এবং মাতা ছিলেন পরম হিতৈষী জোবেদা খাতুন। রাউজানে একটি জনপ্রিয় প্রবাদ ছিল, “রুহুল আমীন চৌধুরীর বাড়ী, জ্ঞানের বাড়ী ”।

মাস্টারবাড়ীর পরিবারের সদস্যরা বংশানুক্রমে তাঁর সততা ও পরোপকারিতার আদর্শ ধারন করে আছেন। দুর্নীতি, অহংকার এবং পঙ্কিলতা মুক্ত জীবনের প্রতীক তাঁর সন্তানরা হলেন খ্যাতনামা শিশু চিকিৎসক ডা. মোমিনুল হক চৌধুরী, অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক চৌধুরী এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী মোজাম্মেল হক চৌধুরী। রুহুল আমিন চৌধুরীর ৬০ বছরের পুরনো মাটির তৈরী ভিটে বাড়ীটি মাষ্টার বাড়ীর ঐতিহ্যের সাক্ষী। আশে পাশে চলছে চোখ ধাঁধাঁনো অট্টালিকা তৈরীর প্রতিযোগিতা। মুছে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতির অনন্য শোভা। তাঁর ভগ্নপ্রায় টিনের ছাউনীযুক্ত মাটির ঘর সামান্য সংষ্কার করে বাসোপযোগী রাখা হয়েছে। অতি সাধারণ আসবাব, ভগ্নপ্রায় চেয়ার ও টেবিল এবং উইপোকায় খাওয়া আলমীরা তাঁর সহজ-সরল জীবনের স্মৃতি বহন করছে। বৈষয়িকতায় স্রােতে ডুবে যাওয়া এ সমাজে সততা পরিমাপের কোন মাপকাঠি নেই। এখন সামাজিক মর্যাদা নিরূপিত হয় অর্থেবিত্তে, আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটে এবং লোকদেখানো আতিথেয়তায়।

লোভের বিষে আসক্ত যে সমাজে চলছে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা, সে সমাজে মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। ১৯৭৮ সালের ১৫ই অক্টোবর ৮৭ বছর জীবনকালের সমাপ্তি টেনে মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কোন অনুষ্ঠান বা আড়ম্বর নেই। মানুষের দোয়াই একমাত্র সম্বল। মৃত্যুকালে তিনি ব্যাংকে, সিন্ধুকে কিংবা ট্রাংকে টাকা বা সম্পদ রেখে যাননি। যাঁর পার্থিব জীবন যত আড়ম্বরমুক্ত, তাঁর পরকালও হবে তত কন্টকমুক্ত। তাঁরা প্রকৃতই মহান আল্লাহাতাআলার ভয় ও ভালবাসায় সিক্ত, ফলে তাঁরা পরকালীন জবাবদিহীতা থেকেও মুক্ত। অর্থ বা ক্ষমতা নয়, কালি ও কলম এবং মেধা ও মনোবল হোক সমাজশুদ্ধির সম্বল। মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরীর মতো আমাদের জীবন হোক শ্বেত, শুভ্র, উজ্জ্বল।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। সসঁহরৎপ@মসধরষ.পড়স

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট