চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘উইপোকা’র মূলোৎপাটন সময়ের দাবি

প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের

১৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

‘উইপোকা’র মূলোৎপাটন সময়ের দাবী বিলম্বে হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ‘উইপোকা’ সমূলে ধ্বংস করার জন্য সন্ত্রাস-মাদক, ক্যাসিনো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। দেশে-বিদেশে এ শুদ্ধি অভিযান বেশ প্রশংসিত হয়েছে। অনেকে এটাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার এ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে আমরাও নির্দ্বিধায় শামিল হতে চাই। শুদ্ধি অভিযানের সফল সমাপ্তির জন্য সরকারের প্রতি আছে দেশবাসীর দোয়া ও শুভ কামনা।

ইতিমধ্যে বিশ^ বসতি দিবসের এক অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হুশিঁয়ারি উচ্চারণ করে বলেন “সরকার সমাজ থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করতে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। আপনি যত বড় নেতা, কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী বা ঠিকাদার হোন না কেন, অনিয়ম-দুর্নীতি করে পার পাবেন না”।

স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা যেখানে বাংলার মানুষ দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারবে, সুন্দর জীবন পাবে এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালের বিয়োগাত্বক ঘটনা বঙ্গবন্ধু সূচিত অগ্রযাত্রাকে থমকে দেয় এবং সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করে। জেনারেল জিয়া এসে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে দেন, ছেটে ফেললেন সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে। জেনারেল এরশাদ আরো একধাপ এগিয়ে মৌলবাদীদের পুনর্বাসন শুরু করেন, প্রবর্তন করেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, গণমাধ্যমে জয়গান চলল মৌলবাদীদের। মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একাত্তরে বাঙালীদের মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল তাতে তাঁরা ফাটল ধরাতে অনেকটা সফলও হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এ দেশের জনগণ সামরিক স্বৈরাচারের কবল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করেন। এরপর প্রায় দু’দশকের বেশী সময় ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্বেও আমরা প্রত্যক্ষ করলাম টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ, দুর্নীতিবাজ, ক্যাসিনোবাণিজ্য, গডফাদার; সর্বশেষ সংস্করণ স¤্রাটের উত্থানই শুধু ঘটেনি; বরং রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি স্তরে রয়েছে এদের উপস্থিতি, প্রতিপত্তি ও আধিপত্য। এমনকি তাঁরা রাজনৈতিক আনুগত্য, দলবাজি ও চাটুকারিতার মাধ্যমে নিজস্ব সা¤্রাজ্য গড়ে তোলে। ক্ষমতা পালাবদল/হাতবদল হলেও এরা দ্রুত উল্টো পথে গাড়ি হাঁকিয়ে চলমান হাওয়ার সাথে মিশে যায়। এদের কর্মকান্ডের ফলে ইমেজ সংকটে পড়ে রাজনৈতিক দল, শেষ পর্যন্ত বিপাকে পড়ে সরকার, ক্ষতি হয় দেশের। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিষয়টি যতটা দ্রুত বুঝবেন, ততটাই মঙ্গলজনক। নইলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর্দশিক রাজনীতির অপমৃত্যু ঘটবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে মুৎসুদ্ধি পুঁজি বা বুর্জোয়া এবং ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা চৌর্যতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকশিত হয়েছে তা একদিন গড়ে উঠেনি। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন সরকারের সময়ে তাঁরা পৃষ্টপোষকতা পেয়েছে। বস্ততঃ দুর্নীতি, অনিয়ম ও পুঁজিলুন্ঠন বাংলাদেশে সমাজ ব্যবস্থায় একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার । ফলে যেমনি গডফাদার কিংবা স¤্রাটের মত সন্ত্রাসীদের আর্বিভাব ঘটে তেমনি উইপোকাগুলো (যেমন অনিয়ম-দুর্নীতি-সন্ত্রাস ইত্যাদি) সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এগুলোকে চিহ্নিত করে মূলোৎপাটন করার কাজ মোটেও সহজ নয়। তবে কঠিন মনে করে যাত্রা অসমাপ্ত রেখে অর্ধপথে হাল ছেড়ে দিলে এঁরা সমাজে আবারও ফিরে আসবে এবং বেশী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। তাই বর্তমান সরকারকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে শক্ত হাতে তাদের মোকাবেলা করতে হবে। শত বাধা বিপত্তি সত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অসমসাহসে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত চলমান শুদ্ধি অভিযানের বিরামহীন যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ অন্তরের অন্তরস্থল থেকে শেখ হাসিনার জন্য কায়মনোবাক্যে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া ও প্রার্থনা করবে-এটা আমার দৃঢ়বিশ^াস।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের যাঁরা বর্ষীয়ান নেতা তাদের অনেকেরই বয়স প্রায় ৮০’ র কোটায়। তাঁরা যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের মনে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসন স্থায়ী করতে চান, তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে সে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করাটাই শ্রেয়। আমরা আশা করব বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত শুদ্ধি অভিযানকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করে সমাজ থেকে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ, মাদক, দুর্নীতি, গডফাদার সংস্কৃতি চিরতরে বিনাশ করা হবে। উইপোকার বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম কেবল সরকার প্রধান করবেন, তা নয়; সর্বস্তরের জনগণকে এ লড়াইয়ে শরীক হতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এ লড়াইয়ের সমর্থনে এগিয়ে আসতে হবে- এটাই সময়ের দাবী। যতক্ষণ না পর্যন্ত উইপোকা সমূলে ধ্বংস না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারসহ সর্বস্তরের জনগণকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় থাকতে হবে। এতেই দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, সুশাসন সুনিশ্চিত হবে, মাথাপিছু আয় বাড়বে, দেশী-বিদেশীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। এ উইপোকাকে সমূলে ধ্বংস করতে পারলে বাংলাদেশ সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত হবে এবং ২০৪১ সালের পূর্বে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বর্তমানে দেশ যেভাবে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশ নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। তবে এটা সত্য যে, সা¤্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী একেবারে বসে নেই। তাঁরাও বেশ সজাগ ও সক্রিয়।

তাই দেশপ্রেম ও সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে অশুভ শক্তির মোকাবেলা সহ ‘উইপোকা’ দমনে পরিচালিত চলমান শুদ্ধি অভিযানকে সফল করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়ে অচিরেই উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র পরিণত হবে – ইন্শাআল্লাহ। সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ন্যায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে বিশ^বাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট