চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রতিরোধে চাই কঠোর পদক্ষেপ থামছে না যৌতুক-হত্যা

১২ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

দেশে যৌতুকের জন্যে নারী নির্যাতনের হার দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে প্রতিদিনকার পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন মর্মান্তিক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। যৌতুকলোভী স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ীদের দ্বারা মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন তো আছেই কোন কোন সময়ে যৌতুকের শিকার হতভাগ্য নারীর সারা শরীরে কেরোসিন কিংবা ডিজেল ঢেলে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও করা হয়। এমনকি এসিডেও ঝলসে দেয়া হয়। এতে অনেকে প্রাণ হারায়, যারা জীবনে বেঁচে যান, তারা সমাজে বেঁচে থাকেন অর্ধমৃত হয়ে অন্যের করুণা নিয়ে। এই অমানবিক প্রবণতা রোধে সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিলেও তা কার্যকর কোন ফল দিচ্ছে না। সর্বশেষ যৌতুকের কারণে নগরীর পাঁচলাইশ থানার নাজিরপাড়া এলাকায় শারমিন আকতার সুমি নামের এক নববধূকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরকম পৈশাচিক ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে দেশের নানা স্থানে। যৌতুকের এই সর্বনাশা চিত্র খুবই উদ্বেগকর।

দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সোমবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুমির মৃত্যু হয়। মাত্র দুই মাস আগে নোয়াখালীর উত্তর শুলিকা এলাকার কামাল উদ্দিনের ছেলে সোলায়মান হোসেনের সঙ্গে সুমির বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে সুমির ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলতো বলে পরিবারের দাবি। পুলিশের ধারণা সুমিকে শ^াস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়ত হাজারো সুমি যৌতুকলোভীদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কেউ মারা গেলে সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত নির্যাতনের খবরটি আসে। আর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে জনগণ জানতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনাই প্রভাবশালীদের চাপসহ নানা কারণে গণমাধ্যম পর্যন্ত আসে না। ফলে যৌতুকের কারণে নারীনির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র জনসম্মুখে আসে না। নানা গবেষণা রিপোর্ট বলছে, দেশের নারীনির্যাতনের যতো ঘটনা ঘটে তার সিংহভাগই হয় যৌতুককে কেন্দ্র করে। যৌতুকের এই ভয়াল থাবায় পিষে মরছে উচ্চবিত্ত থেকে নি¤œবিত্ত পরিবারের অসহায় মেয়েরা। প্রসঙ্গত, প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে গোচরে-অগোচরে নারীরা যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। এক সময় এ জনপদে বসার পিঁড়িটি পর্যন্ত যৌতুক হিসেবে দিতে হতো। বর্তমান সভ্যতার চরম উৎকর্ষের সময়েও সেই চিত্রের বদল হয়নি। শুধু বদল হয়েছে নির্যাতনের ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন আঙ্গিকের। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষের সময়েও যৌতুকের অভিশাপ সমাজদেহের প্রতিটি রন্ধে পৌঁছে গেছে। সভ্যতা-সংষ্কৃতি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রগতির জন্যে তা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন গবেষণা জরিপ এবং প্রতিদিনকার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপে যৌতুকের কারণে নারীনির্যাতনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা রীতিমতোই ভয়াবহ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন যৌতুককে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

পারিবারিক সহিংসতার পেছনে যে বিষয়গুলো প্রধান অনুঘটকের কাজ করে সেগুলো হচ্ছে যৌতুকের দাবি মেটানোর অক্ষমতা, বহুবিবাহ, কন্যাসন্তান জন্মদান, স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ, দেন-মোহর পরিশোধ না করা, দারিদ্র, পরকীয়া বা স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ। এসবের মধ্যে নারীনির্যাতনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে যৌতুক। এই যৌতুকপ্রথা আমাদের দেশের বিবাহিত বা অবিবাহিত নারীর জীবনে দুর্বিষহ ও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার পরিসমাপ্তি ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ, আত্মহনন অথবা নির্মম হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে। জানা যায়, নারীর অপমৃত্যুর ৭৫ ভাগই হয় যৌতুকের জন্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে। যৌতুকের জন্যেই পৈশাচিক নির্যাতন, এসিডদগ্ধ করা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আইন থাকলেও প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। ফলে যৌতুকের মতো কালব্যাধি সমাজকে গ্রাস করে আছে। এখন সমাজজীবনে এক ভয়াবহ অভিশাপ হিসেবে নেমে এসেছে যৌতুকপ্রথা।

সব মানুষের জন্যে একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চাইলে যে কোনো মূল্যে যৌতুকের সর্বগ্রাসী বিস্তার রোধ করতে হবে। এবং তা এখনই। এ বিষয়ে খামখেয়ালির সুযোগ নেই। আইন প্রণয়নের পর বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবায়ন না হলে উদ্দেশ্য সাধন হয় না। আইন কতটা কল্যাণকর হবে তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। তাই যৌতুকের মতো জঘন্য অপরাধকে সমাজ থেকে দূর করতে চাইলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাশাপাশি সমাজে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তি, আলেম-উলেমা এবং রাষ্ট্রকেও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট