চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা : বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়

ডা. সাগরিকা শারমীন

১২ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

আমেরিকার ঘধঃরড়হধষ ইৎবধংঃ ঈধহপবৎ অধিৎবহবংং গড়হঃয (ঘইঈঅগ) একটা বাৎসরিক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য প্রচারণা, যেটা অক্টোবর মাসে পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হল ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে জনগণকে সচেতন করা সেই সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সার এর কারণ, কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, ডায়াগনোসিস, চিকিৎসা, প্রতিষেধক ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণার জন্য একটা তহবিল তৈরি করা। এছাড়াও যারা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত তাদেরকে তথ্য ও সমর্থন দেয়াও এই প্রচারণার কাজ। সবচেয়ে বড় যে কাজটি এই ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাসে করা হয় তা হল জনগণকে আরলি স্ক্রিনিং সম্পর্কে সচেতন করা।

ইতিহাস কি বলে? ঘইঈঅগ স্থাপিত হয় ১৯৮৫ সালে। এটা আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি আর ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ফার্মাসিউটিকাল বিভাগের যৌথ উদ্যোগে প্রথম স্থাপিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল ম্যমোগ্রাফিকে প্রাথমিক স্তরে ব্রেস্ট ক্যান্সার সনাক্তকরণের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী অক্টোবর মাসকে ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বহু ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়।

গোলাপি রিবন : ১৯৯৩ সালে ইভিলিন লাউডার এস্টী লাউডার কোম্পানির করপোরেট শাখার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, ব্রেস্ট ক্যান্সার রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠন করেন এবং এর প্রতীক হিসেবে প্রথম গোলাপি রিবন ব্যবহার করেন। যদিও রিবনের ব্যবহার সেটাই প্রথম নয়। এর আগে ক্যালিফোর্নিয়াবাসী ৬৮ বছর বয়সী মহিলা চার্লট হেলি, যার বোন, মেয়ে, নাতি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল, তিনি পিচ রঙের রিবন বিতরণ করেছিলেন ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার জন্য। কারণ তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন যে এই ব্যপারে পর্যাপ্ত তহবিল এবং দৃষ্টি নেই কারো।

পুরুষদের কি ব্রেস্ট ক্যন্সার হতে পারেনা? সমাজের একটি প্রচলিত ধারণা ব্রেস্ট ক্যান্সার শুধুমাত্র মহিলাদের হয়, সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি ধারণা। যদিও পুরুষদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার প্রবণতা কম, প্রতি ১০০,০০০ জনে ১ জন পুরুষ প্রতি বছর ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এক হিসেবে দেখা যায় প্রতি ১০০ জন ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর মধ্যে ১ জন পুরুষ, ৯৯ জন মহিলা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে ৪১ হাজার মহিলা এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, পক্ষান্তরে ৩০০ জন পুরুষ এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। পুরুষের হার কম হলেও, এর ভয়াবহতা বেশি। এইসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ২০০৯ সাল হতে সারা বিশ্বে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহকে “পুরুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা সপ্তাহ” হিসেবে পালন করা হয়।
ব্রেস্ট ক্যান্সার, বিশ্ব পরিস্থিতি : ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অমবহপু ভড়ৎ জবংবধৎপয ড়হ ঈধহপবৎ (ওঅজঈ) এর হিসাব মতে

প্রতি বছর সারাবিশ্বে ১৩৮ মিলিয়ন নতুন ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগী সনাক্ত করা যাচ্ছে, যাদের মধ্যে ৪৫,৮০০ জন রোগী প্রতিবছর মারা যাচ্ছে এই রোগে। আগে যদিও ভাবা হত উন্নত বিশ্বেই এই রোগের প্রকোপ বেশি, কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের রোগী বেড়ে যাচ্ছে এবং প্রায় ৫৮% মৃত্যু শুধুমাত্র অনুন্নত দেশে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, শহরমুখী প্রবণতা, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া, খাবারের ধরনের পরিবর্তন ইত্যাদিকে শনাক্ত করা হচ্ছে। এক হিসেবে দেখা যায়, অনুন্নত বিশ্বে প্রতি ১০০,০০০ জনে ১৯৩ জন মহিলা, এবং পশ্চিম ইউরোপে প্রতি ১০০,০০০ জনে ৮৯৭ জন মহিলা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। ২০১৭ এর ২৬শে এপ্রিলের এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের হার বেলজিয়ামে, এখানে প্রতি ১০০,০০০ জনে ১১১৯ জন মহিলা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন।
দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ডেনমার্ক, তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০, ০০০ জনে ১০৫ জন ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড। সবগুলোই পশ্চিম ইউরোপের দেশ।

বাংলাদেশ এবং আমাদের চট্টগ্রাম : বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে তেমন কোন আপডেট পরিসংখ্যান নেই, যদিও ব্রেস্ট ক্যান্সারের হার দিন দিন আশংকাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। যেটা খুব সহজেই একটু সচেতন হলেই অনেকখানি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০,০০০ জনে ২২৫ জন নারী তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৩ জনের বয়স ১৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে। আরেক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারী মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি ব্রেস্ট ক্যান্সার এর কারণেই ঘটে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগের পাঁচ বছরের এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১৪ সালে চিকিৎসা নিতে আসা ক্যান্সার রোগীদের ৪২% নারী, যেখানে ২০১৮ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭% এ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরেই নারীদের ক্যান্সার আক্রান্তের প্রবণতা বেড়েছে ৫%। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালে নারী ক্যান্সারের ১৯.৯৯% ব্রেস্ট ক্যান্সার, ২০১৫ সালে সেটা দাঁড়ায় ২৪% এ। সর্বশেষ ২০১৮ তে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭%এ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই চট্টগ্রাম অঞ্চলেই প্রতি বছর নারীদের ক্যান্সার প্রবণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্রেস্ট ক্যান্সারের হার।
কি কি কারণে পিছিয়ে বাংলাদেশ? যেসব কারণ সনাক্ত করা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষ্মণ সম্পর্কে অজ্ঞতা। ২. প্রাথমিক অবস্থায় কোথায় যোগাযোগ করবে সে সম্পর্কে ধারণা না থাকা। ৩. আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া। ৪. পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের চিকিৎসার ব্যপারে অবহেলা। এবং ৫. সর্বোপরি স্ক্রিনিং সম্পর্কে অজ্ঞতা।

প্রতিরোধের উপায় : ১. জনগণকে বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেক্টরে যেসব মাঠকর্মী, নার্স, মেডিকেল অফিসার, প্যারামেডিক্স কাজ করেন তাদেরকে ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষ্মণ, স্ক্রিনিং বিষয়ে অবহিত করা এবং এই ব্যাপারে রেগুলার সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা। ২. সমাজের নারী-পুরুষ সকলকে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সচেতন করা। ৩. ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং পদ্ধতিকে সুলভ ও সহজ করা। ৪. দেরীতে আসলে আর্থিক সামাজিক উভয় প্রকার ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে জানানো অর্থাৎ যথাযথ কাউন্সেলিং।

পরিশেষে, ব্রেস্ট ক্যান্সার বাংলাদেশের নারীদের জন্য এখন একটা গুপ্তঘাতক। শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে আমাদের নারীরা চিকিৎসা নিতে দেরী করছেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ক্যান্সারে মারা যাওয়া নারীদের ৬৯% মারা যায় ব্রেস্ট ক্যান্সারে, যাদের অধিকাংশেরই বয়স ৪৫ এর নীচে। বাংলাদেশ আজ প্রজননস্বাস্থ্যের অমানিশা কাটিয়ে অনেকখানি এগিয়ে, কিন্তু অপ্রজননস্বাস্থ্য বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সারের মত বিষয়ে অনেক কদম পিছিয়ে। শত বাঁধা পেরিয়ে এই পথে আগাতে দরকার সচেতনতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের।

ি ডা. সাগরিকা শারমীন সার্জারী বিশেষজ্ঞ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট