চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

বিবাহ শাদী : ইসলামি বিধান

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১১ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০০ পূর্বাহ্ণ

যে সব নারীকে বিয়ে করা হারাম:
১.মা. মায়ের মা, মায়ের ফুফু, খালা, যত উপরে যাবে এবং বিমাতা । ২. আপন মেয়ে, মেয়ের মেয়ে এবং যত নিচে যাবে। ৩. সহোদর ভগ্নী, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় ভগ্নী ৪. আপন ফুফু ও পিতার বৈমাত্রেয় এবং মৈাত্রেয় ভগ্নী ৫. আপন খালা ও মায়ের বৈপিত্রেয় এবং বৈমাত্রেয় ভগ্নী ৬.আপন ভাইয়ের মেয়ে, এবং বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে এবং যত নিচে যাবে। ৭. আপন বোনের মেয়ে এবং বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রেয় বোনের মেয়ে এবং যত নিচে যাবে ৮. দুধমা, দুধবোন, দুধবোনের মেয়ে যত নিচে যাবে। ৯. দুধ দাদী ও নানীগণ। ১০. স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর মেয়েগণ যত নিচে যাবে। ১১. আপন ঔরসজাত পুত্রের বৌ ও তৎপুত্রের বৌ যত নিচে যাবে। ১২. সহোদর দুই বোনকে এক সঙ্গে বিয়ে করা, একসঙ্গে ভাইঝি ও ফুফু এবং ভাগ্নী ও খালাকে েিবয় করা। ১৩. যার স্বামী আছে তাকে বিয়ে করা ১৪. শাশুড়ী।

শরীয়াতের বিধানমতে উল্লেখিত সব কয়জন স্ত্রীলোককে বিয়ে করা হারাম। উল্লেখ্য যে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একজন যদি মুসলমান হয়, অপর জন ইসলাম ত্যাগ করে, তবে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। তখন আর স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করা জায়েজ নয়, হারাম। (দুররে মুখতার, ২য় খন্ড)

বিয়ের নিয়ম ও মোহরানা: বিয়ে আল্লাহতায়ালার একটি বড় নিয়ামত। এর দ্বারা দীন দুনিয়ার বহু উপক্রা সাধিত হয়। বিয়ে দ্বারা মানুষ গুনাহ থেকে রক্ষা পায়। বিয়ের রোকন দুইটি যথা: ১. ইজাব- বর বা কনের পক্ষ থেকে প্রথমে যে প্রস্তাবনা হয়। ২. কবুল – প্রস্তাবের পর বর কনের দ্বিতীয়জন যে সম্মতি ব্যক্ত করেন।
বিয়ের শর্তাদি- ১. মাহর বা মোহরানা প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে নির্ধারণ করা। ২. দুইজন সাক্ষী থাকা

যদি বাগদানের অনুষ্ঠানে বর – কনের ইজাব-কবুল করা হয় এবং দু’জন সাক্ষী থাকেন তাহলে বিয়ে হয়ে যাবে, আর যদি এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানে ইজাব-কবুল না হয় তাহলে তা বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে না । তবে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় টেলিফোনেও বিয়ে হতে পারে। বলপ্রয়োগে বিয়ে বা গোপন বিয়ে ইসলামে সিদ্ধ নয়।

মোহরানা: মোহরানা বিয়ের একটি শর্ত যা অবশ্যই পালনীয়। কুরআনপাকে বলা হয়েছে- ‘ হে নবী! আমি আপনার স্ত্রীগণকে আপনার জন্য হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা দিয়েছেন’ (সূরা -৩৩ আহযাব আয়াত – ৫০)। মাহরের নিম্নতম পরিমাণ ১০ দিরহাম বা রৌপ্য মুদ্রা (আরব আমিরাতে বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী ১০ দিরহাম ১৬০ টাকার সমান)। এর থেকে কম মাহর হতে পারে না। বেশীর কোন সীমা নির্ধারিত নেই। উভয়পক্ষ রাজী হয়ে যে পরিমাণ পারস্পরিক সম্মতিতে নির্ধারণ করবে তাই হবে। মহানবী (স.) বলেছেন – মোহরানা দু ধরনের হতে পারে: ১. মোহরে মোআজ্জাল র্অর্থাৎ নগদ প্রদেয় ২. মোহরে গায়েরে মোআজ্জাল অর্থাৎ বিলম্বে প্রদেয়। প্রথমটি তলবমাত্র এবং দ্বিতীয়টি মৃত্যু বা তালাকের আগে দিতে হয়। সহবাস হলে পূর্ণ মোহরানা এবং সহবাস না হলে অর্ধেক মোহরানা দেওয়া ফরয। যেখানে মোহরানা ধার্য হয়নি সেখানে স্ত্রীর পরিবারের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের মোহরানা অনুসারে ধার্য হবে, একে মাহরে মেসাল বলে। স্ত্রী যদি নিজ খুশিতে স্বামীকে তার কিছু অংশ বা স¤পূর্ণ মাহর মাফ করে দেয় তবে মাফ হয়ে যাবে। স্বামী ভবিষ্যতে যাতে তার স্ত্রীকে দাসী রূপে না দেখে বরং সম্মানীয় অভিজাত নারী হিসেবে দেখে তার প্রতীকস্বরূপ স্বামীকে মাহর দিতে হয়।

বিয়ে একটি পবিত্র চুক্তি: ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে কোন মামুলি সম্পর্ক নয়। এটা কোন সাময়িক বা অস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। বিয়ে হলো একটি পবিত্র চুক্তি। আল কুরআনে বিয়েকে বলা হয়েছে একটি পবিত্র চুক্তি’ ‘আর কিভাবে তা তোমরা তা (মোহরের অর্থ) ফেরত নেবে, যখন তোমরা এক অপরের সাথে সঙ্গত হয়েছ এবং তারা (নারীরা) তোমাদের নিকট থেকে নিয়েছে একটি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি’ (সূরা আন নিসা আয়াত -২১)।

বিয়ে মুসলিম সমাজে একটি পবিত্র অঙ্গীকার এবং চুক্তি। ইসলামে বিয়ে-বিচ্ছেদের অনুমতি আছে। সকল অনুমোদিত কাজের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় কর্ম হলো তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ। কিন্তু কোন উপায় না থাকলে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন ইসলামে আছে।

মহানবী (স.) বলেন- অবশ্যই বৈধ বিষয়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বিষয় হলো বিবাহবিচ্ছেদ’। (আবু দাউদ এবং ইবনে মাযা)।

মহানবী (স.) আরো বলেন- ‘বিয়ে করো কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ করো না। অবশ্যই আল্লাহ কেবল স্বাদ বৈচিত্র্যের তালাশে বহু বিবাহকারীদের পছন্দ করেন না।’

আর যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যায়, ইদ্দত পালন করতে হবে। গর্ভবতী মহিলার জন্য সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হয়। যে স্ত্রীর স্বামী মারা গেছে তার জন্য চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করা ফরয।
একাধিক বিয়ে বা বহু বিয়ে: সর্বজ্ঞানী মহান অন্তর্যামী আল্লাহতায়ালা একজন পুরুষকে একই সাথে চারজন স্ত্রী রাখার অধিকার দান করেছেন। অল্লহ প্রদত্ত ও শর্তসাপেক্ষ অধিকার খর্ব বা নিষিদ্ধ করার বা এর ওপর কোন অঙ্গত শর্ত আরোপ করার অধিকার কারো নেই। কেউ একাধিক বিয়ে করলে স্ত্রীদের মধ্যে সকল বিষয়ে সমতা রক্ষা করে তাদের ভরণ-পোষণের বন্দোবস্ত করাও স্বামীর ওপর ফরয এবং সে ফরয পালন করতেও স্বামী বাধ্য। একাধিক স্ত্রীর মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কেবল একজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশ রয়েছে।

ইসলামে বহু বিয়ের কথা বহুল আলোচিত। কোন কোন মুসলিম অবশ্য ইসলামে বহু বিয়ের ব্যাপারটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এবং সুযোগের অপব্যবহারও করে থাকে। ইসলামে বহু বিয়ের অনুমোদন শর্ত সাপেক্ষ। বহু বিয়ের অনুমোদন সম্পর্কে আল-কুরআনের প্রাসঙ্গিক আয়াতটি দেখা যেতে পারে: ‘ যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে এতিম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না। তবে, বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে এক জনকে..’। (সূরা আন নিসা আয়াত-৩)। আলোচ্য আয়াতে নিজের পোষ্য এতিমদের বিয়ে করলে তাদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান ও সুবিচার না করার আলোচ্য আয়াতে নিজের পোষ্য এতিমদের বিয়ে করলে তাদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান ও সুবিচার না করার অবকাশ থাকে। সেজন্য নিজের পোষ্য এতিম ভিন্ন অন্য নারীকে বিয়ে করার কথা বলা হয়েছে।
অহুদ যুদ্ধের পরেই এই আয়াত নাযিল হয়। তখন মুসলিম সমাজে ছিল বহুসংখ্যক বিধবা এবং তাদের এতিম সন্তান। তদুপরি ছিল যুদ্ধকালে যুদ্ধবন্দী বহু নারী। তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য নয় বরং সবচেয়ে বেশি মানবতাবোধ এবং দয়া মায়ার সঙ্গে দেখার নির্দেশ ছিল।

একাধিক বিয়েতে সকলকে সমানভাবে ভালবাসা সম্ভব নয়। তবে আহার-বিহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান, বিনোদন, খোঁজখবর নেয়া, সকল স্ত্রীর সন্তানদের প্রতি সমান ব্যবহার এ সমস্ত দিকে সমতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। মূলত: বিশেষ প্রয়োজনে ও অনিবার্য কারণে পুরুষের জন্য একাধিক বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়।

ি মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট