চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১৯ আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতন হই

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শফিউল হাসান

১০ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

আত্মহত্যা সারাবিশ্বের মৃত্যুর প্রথম দশটি কারণের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আত্মহত্যার হার বিভিন্ন রকম। যেমন যুক্তরাজ্যে, আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু হৃদরোগ এবং ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর পর তিন নম্বর কারণ। পূর্ব-উত্তর ইউরোপে আত্মহত্যার হার বেশী। ভূমধ্যসাগরীয় দেশে আত্মহত্যার হার কম। ইসলামী দেশসমূহে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে কম। আত্মহত্যার প্রবণতা মহিলাদের চেয়ে পুরুষের মাঝে তিনগুন। বেশী আত্মহত্যার হার বয়স্কদের (পুরুষ ও মহিলা) মাঝে সর্বোচ্চ।

বিবাহিতদের মাঝে আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে কম। আত্মহত্যার হার বিধবাদের মাঝে বেশী এবং বেকারদের মাঝেও বেশী। বন্দীদের মাঝে বিশেষ করে যাদের রিমান্ডে নেয়া হয় তাদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশী। কোন কোন পেশায় আত্মহত্যার হার বেশী। যেমন উন্নত দেশে গবেষণায় দেখা যায় চিকিৎষকদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশী। বিশেষ করে মহিলা চিকিৎষকদের মাঝে (গবষষ ুড়ৎ ২০০৮) চিকিৎসকের মাঝে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে- ঔষধের প্রাপ্যতা, মদ ও অন্যান্য- ঔষধের নেশা, কর্মক্ষেত্রে মানষিক চাপ, বিষন্নতা, চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ এবং চিকিৎসাপেশা নির্বাচনের ব্যাপারে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব। বিশেষ করে যেসব চিকিৎষক এনেসথেসিয়া বিভাগে কাজ করেন, কমিউনিটি হেলথ চিকিৎষক, জেনারেল প্রাকটিশনার এবং মনোচিকিৎষক (ঐধুিড়হ ২০০১).

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে আত্মহত্যার সঠিক কারণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। কারণ নির্ণয় অনেক সময় দুরূহ ব্যাপার। কারণ, আত্মহত্যাজনিত মৃত ব্যক্তির সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা যায়না। আত্মহত্যার কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন বিশেষ করে ময়নাতদন্তের মাধ্যমে।
দূরবর্তী কারণসমূহ ঃ জন্মগত ঝুঁকি, ব্যক্তিত্বজনিত বৈশিষ্ট্য, নবজাতকের সীমিত বয়সবৃদ্ধি, প্রাথমিক জীবনের মানসিক আঘাত ও হরমোনজনিত কারণ।

নিকটবর্তী কারণসমূহ ঃ মানষিক রোগ, শারীরিক রোগ, মনোসামাজিক সংকট, আত্মহত্যার সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও মডেলিং এর প্রতি ঝোঁক।

মানসিক রোগের কারণে আত্নহত্যা ঃ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় শতকরা নব্বই ভাগ (৯০%) মানসিক রোগের কারণে আত্মহত্যা করে। সাধারণত নি¤েœ বর্ণিত মানসিক রোগের কারণে বেশীরভাগ আত্মহত্যা হয়ে থাকে। ১. বিষন্নতা : আনুমানিক ৪% লোক বিষন্নতাজনিত কারণে আত্মহত্যা করে থাকে। ২. ব্যক্তিত্বের সমস্যা (চবৎংড়হধষরঃু ফরংড়ৎফবৎ) : যারা আত্মহত্যা করে তাদের মধ্যে ৪০%-৫০% লোক ব্যক্তিত্বের সমস্যাজনিত রোগে ভোগেন। ৩. মদের অপব্যবহার : সাধারণ মানুষের মাঝে ৭% লোকের আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে মদের অপব্যবহারের কারণে। ৪. মাদকাসক্তির কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশী। ৫. সিজোফ্রেনিয়া রোগ, আনুমানিক ৫% লোক এই রোগের কারণে আত্মহত্যা করেন।
সামাজিক কারণসমূহ ঃ গবেষণায় দেখা যায় অর্থনৈতিক মন্দাকালীন সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশী দেখা যায়। বর্তমানে অধিক কর্মহীনতা, দারিদ্রতা, বিবাহ বিচ্ছেদ ও সামাজিক ভংগুরতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যার মিডিয়া কভারেজের কারণেও আত্মহত্যার উপর প্রভাব বিস্তার করে।
জৈবিক কারণসমূহ ঃ পরিবারের মাঝে আত্মহত্যার ইতিহাস থাকলে আত্মহত্যার সম্ভাবনা বেশী থাকে। বয়সের তারতম্যের কারণে আত্মহত্যার তারতম্য ঘটে। অনেক দেশে ৭৫ বয়সের উর্ধ্বের লোকের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি। শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার হার কম। কিশোর বয়সীদের মাঝে আত্মহত্যার হার বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অধিক ঝুঁকিপূর্ণ পেশার গ্রুপ ঃ চিকিৎষকদের মাঝে আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী। বিশেষ করে মহিলা চিকিৎসকের মাঝে আত্মহত্যার হার পুরুষ চিকিৎষকের চেয়ে বেশী। চিকিৎষকের মাঝে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, চিকিৎসা গ্রহণে অবহেলা, ঔষধের সহজপ্রাপ্যতা, পেশা নির্ণয়ে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব এবং মাদকাসক্তি। আত্মহত্যার কারণ নির্ণয় জানা থাকলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সহজ। আমরা জানি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

এবার আসা যাক আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনায়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রথমেই প্রয়োজন আত্মহত্যার ঝুঁকি নির্ণয় করা। প্রতি চিকিৎষককে আত্মহত্যার ঝুঁকি নির্ণয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। অনেক সময় চিকিৎসক আত্মহত্যার ঝুঁকি নির্ণয় করা সত্তেও কখন যে আত্মহত্যা করে ফেলে বলা দুষ্কর। রোগী যখন আত্মহত্যার ইচ্ছা সরাসরি প্রকাশ করে তখন সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। যারা আত্মহত্যা করে তাদের মধ্যে ২/৩ ভাগ লোক আত্মহত্যার ইচ্ছা কাউকে না কাউকে বলে থাকেন। অনেক রোগী আত্মহত্যার ভয় দেখায় আত্মহত্যা করার পূর্বে অনেক সময় রোগী ভিন্নভাবে আত্মহত্যার ইশারা দিয়ে থাকে সরাসরি না বলে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়ঃ আত্মহত্যার ঝুঁকি নির্ণয়ের পর চিকিৎষকের উচিত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রোগীকে উৎসাহিত করা। প্রথম পদক্ষেপ হলো রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত না বর্হিবিভাগীয় চিকিৎসা দেয়া উচিত। চিকিৎসককে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যা নির্ভর করে আত্মহত্যার প্রবণতার তীব্রতার উপর। যদি আত্মহত্যার ইচ্ছার তীব্রতা নির্ণয় করা যায় তাহলে রোগীকে অবশ্যই মানসিক বিভাগে অথবা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। রোগীর হাসপাতালে ভর্তি জরুরী হলে, যদি রোগী ভর্তি হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে তাহলে অনেক দেশে নির্বাহী জরুরি আদেশে রোগী হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
যেসব রোগীর হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন নেই সেসব রোগীকে কিভাবে কমিউনিটিতে চিকিৎসা করা যায় তার ছক নিচে দেখানো হলো।

১. কমিউনিটিতে আত্নহত্যা জাতীয় রোগীর যত্ন। ২. রোগী এবং রোগীর সেবাদানকারীর পরিপূর্ণ পরিক্ষা। ৩.পরিপূর্ণ সামাজিক সহায়তাকারী সংস্থা। ৪. নিয়মিত আত্নহত্যার ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ। ৫. নিরাপদ মানসিক রোগের ঔষধের ব্যবহার। ৬. ছোট প্রেস্ক্রিপশন। ৭. ঔষধ নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য আত্নীয় স্বজনদের উদ্বুদ্ধ করা। ৮.জরুরী অতিরিক্ত সাহায্যের ব্যবস্থা রাখা।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের করণীয় ঃ ১. উন্নত ও সহজলভ্য মানসিক সেবা। ২. আত্নহত্যার উপায়সমূহ সীমিতকরণ। ৩. দায়িত্বশীল মিডিয়ার মাধ্যমে উৎসাহিতকরণ। ৪. শিক্ষানীয় প্রোগ্রামসমূহ। ৫. ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য উন্নত সেবা। ৬. সংকত নিরাময় কেন্দ্র এবং হটলাইন টেলিফোন।

বর্তমান বিশ্বে ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ’ মনোবিজ্ঞানীদের জন্য চ্যালেঞ্জ। বিবিধ মানসিক সমস্যার ফলে আত্মহত্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ মনোবিজ্ঞানীদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। সচেতন হতে হবে পরিবারের সদস্যদের। সর্বস্তরের পেশাজীবীদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে মিডিয়ার বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের ফলে জনগণকে আত্মহত্যার কারণসমূহ জানাতে হবে। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে আত্নহত্যা প্রতিরোধে। বিভিন্ন ধরনের সেমিনার, সিম্পেজিয়ামের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে একটি আত্মহত্যা শুধু পরিবার নয়, একটি সমাজ ও দেশের উপর প্রভাব ফেলে। আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতন হই।

ি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শফিউল হাসান : অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম; এক্স সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট