চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

পুলিশবাহিনীর সংস্কার সময়ের দাবি

মো. দিদারুল আলম

১৪ আগস্ট, ২০২৪ | ১:১১ অপরাহ্ণ

সাম্প্রতিক আন্দোলন ঠেকানোর ঘটনাপ্রবাহে জনগণ পুলিশের প্রতি ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণগুলো খুবই স্পষ্ট। এজন্য সবার আগে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিহীন পেশাদারি পুলিশকে সক্রিয় হওয়া দরকার। রাজনৈতিক লেজ ধরে এবং অবৈধভাবে আয় করা গুটিকয়েক পুলিশ দোষী হলেও দেশের সিংহভাগেরই পুলিশ যেমন খারাপ নয়, তেমন পুলিশ ডিপার্টমেন্টও। এটি আমাদের সকলেরপ্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সবাই মিলে মিশে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেশের কল্যাণে নতুন উদ্যমে আবারো কাজ শুরু করতে হবে।প্রত্যেক পেশাতে ভালো-খারাপ লোক আছে। পুলিশের সাথে জনগণের সরাসরি যোগাযোগ বেশি হয় বলে তাদের অসঙ্গতিগুলো বেশি চোখে পড়ে। বর্তমানে দেশে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। পুলিশ বাহিনীও এর ব্যতিক্রম নয়।

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় ক্ষমতাসীনদের অর্ডার মানতে গিয়ে একের পর এক গুলি ও মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ছিলেন পুলিশের অনেক সদস্য। সবচেয়েবেশি আলোচিত ঘটনা ছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ কর্তৃক গুলি করে হত্যার ঘটনাটি ও পানি লাগবে পানি বলা মুগ্ধর ঘটনাটিও। সেই ভিডিওগুলো ঝড় তোলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায়।কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারের হটকারি আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশরাগোটা দেশের মানুষের কাছে খারাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন মোকাবেলা করতে গিয়ে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে তাদেরকে হার্ডলাইনে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে নিষ্ঠুরতায় নামতে বাধ্য করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হয়ে গেছেন গণশত্রু। শেষপর্যন্ত নিজেদের জীবন রক্ষার্থে কর্মস্থল ছেড়ে সবাই একযোগে চলে গেছেন। এই নাজুক অবস্থা পৃথিবীর আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কখনও ঘটেছে বলে মনে হয় না। যেটা গোটা জাতির জন্য চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।২০০৭ সালে তদানিন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ইউএনডিপির সহয়তায় পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে বিভিন্ন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের পুলিশি ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে ‘দি বাংলাদেশ পুলিশ অর্ডিন্যান্স ২০০৭’-এর খসড়া তত্ত্বাবাবধায়ক সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়নি। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ জারি করার জন্য বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।তবে খুশির কথা, সব থানায় পুলিশ যোগদান করেছেন এবং ট্রাফিক পুলিশও কাজে নেমেছে। সপ্তাহখানিকথানায় পুলিশবিহীন অবস্থায় দেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে তার রেকর্ড রাখার মতো কোনো পরিস্থিতি পুলিশ থানায় ছিল না।এই কয়দিন পুলিশ বাহিনী কর্মস্থলে না থাকায় বোঝা গেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁদের ভূমিকা কতটা জরুরি। আমাদের উচিত দেশকে রক্ষার্থে পুলিশের পাশে এসে দাঁড়ানো, পুলিশকে সহযোগিতা করা এবং বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে তাদের পাশে গিয়ে সাহস যোগানো। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে কর্মস্থলে যোগদান করার জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় দিয়েছে।তার আগে তাঁরা যোগদান করেছেন।

 

কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের একটা পর্যায় নাগাদ পুলিশ উল্লেখযোগ্য সহিংসতায় জড়ায়নি, তবে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ অনেকের অভিযোগ, সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ শিক্ষার্থীদের ভয়দেখাতে বিভিন্ন জায়গায় গুলি করেন।পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত কিছু কিছু পুলিশ সদস্যদের প্রয়োজনীয় আচরণগত পরিবর্তন আনার প্রতি চেষ্টা করা। যদি পুলিশের জন্য করা নিয়মকানুন ও পুলিশকে উন্নত করা হয় এবং পুলিশ বাহিনীকে প্রযজোনীয়প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় তাহলে পুলিশের আচরণে আশানুরূপ পরিবর্তন আসবে, তখন তাদেরকে সবাই বিশ্বাস করতে পারবে।বর্তমানে যোগদানকৃতপুলিশের মধ্যে অনেক ভয় কাজ করছে। এজন্য সাধারণ মানুষকে পুলিশের সঙ্গেযোগাযোগ বাড়াতে হবে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষের প্রতিও পুলিশের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিগত কয়েক দিনে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্ধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সেই অভাবটা পূরণ করতে হবে। পুলিশ মানুষের জন্যই কাজ করে। তাই সাধারণ মানুষকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা বা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিক দলগুলোতাদের মতো করে ব্যবহার করলে মানুষের আস্থা হারানোটাই স্বাভাবিক। সব সরকারের আমলে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ফলে বিগত কয়েক বছরে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের অনেক থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এগুলো উদ্ধার করতে হবে। তা না হলে অরাজকতা বাড়বে। পুলিশকে আগে কাজ করতে দিতে হবে। তার পর পুলিশ সিদ্ধান্ত নেবে কোনটা আগে ও পরে করবে। পুলিশ একসঙ্গে সব কাজ করতে পারবে না।এখন দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। উপদেষ্টারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলবেন। এখন পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। পুলিশ এখন ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। দেশে যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে, তাদের ওপর আমরা আশাবাদী।আশা করি, দেশে ভালো কিছু হবে। বাংলাদেশের অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।বাংলাদেশের এই সংকটময় মুহূর্ত অচিরেই কেটে যাবে এবং দেশ অনেক এগিয়ে যাবে, সেই প্রত্যাশা করি।
পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফেরাতে কিছু কাজ অবশ্যই করতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশি মতো নির্দেশ দানের কারণেই পুলিশের এই দশা হয়েছে।ছাত্র-জনতা যে রকম পুলিশ অফিসার চাচ্ছে, সে রকম পুলিশ অফিসার আমাদের ডিপার্টমেন্টে আছে। কিন্তু তারা ফ্রন্টে আসতে পারে না। তাঁদের খুঁজে বের করে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের দাবিগুলো হলো- পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে।সব পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব “সিনিয়র অফিসাররা ক্ষমতা লোভী ও দালাল পুলিশ অফিসারদের কারণে আমাদের পুলিশ সদস্য ও সাধারণ ছাত্র-জনতা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদেরকে গ্রেফতার করে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার করতে হবে।তাদের সব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশ পুলিশের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।সহিংসতায় নিহত ও আহত পুলিশ সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যেসব পুলিশ সদস্য জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থানেওয়া যাবে না।বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী পুলিশ সদস্যদের জন্য আট ঘণ্টা ডিউটির ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য ওভারটাইম পেমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে।পুলিশের পোশাকের রং পরিবর্তন করে কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত একই ড্রেস কোড হতে হবে। পুলিশ বাহিনীর সব দাবিগুলো মানাসম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবে কিছু কিছু বিষয় বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনীকে কোনো সরকারের আমলে এই ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাতে না হয়, এজন্য দেশের আপামর লোকজন পুলিশ বাহিনীতে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন বলে মনে করেন।

মো. দিদারুল আলম কথাসাহিত্যিক ও কলেজ-শিক্ষক।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট