চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কিছু মানুষ

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম

১৪ আগস্ট, ২০২৪ | ১২:৫৫ অপরাহ্ণ

জীবনে চলার পথে অসংখ্য মানুষের সাথে দেখা হয়, পরিচয় হয়। যাদের সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হয় তারা সবাই ‘ইম্পরট্যান্ট’, কারো সাথে কথা দিয়ে, কারো সাথে কাজ দিয়ে আমরা ইন্টারএকশান করি। দু’চার জন স্মৃতিতে অন্যদের ছাপিয়ে যায়। আবার বামপন্থী আইকন লেখক বদরুদ্দীন উমর সাহেব ১৯৯৬ সালে তার পরিচিত ৭২ জন ব্যক্তি নিয়ে এক বই লিখেছেন। উনি অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সুসাহিত্যিক। তার পরিচিত ব্যক্তি হাজার ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই। আমি দু-চারজন মানুষ নিয়ে কিছু লিখতে চাই। মনে হয়েছে এরা বেশ মজার মানুষ। পাঠক ও হয়ত তাদের কাহিনি উপভোগ করবে।

 

বাবু ভাই : ১৯৭৩ এর টালমাটাল রাজনীতি ১৯৭৫-এও চলতে থাকে। তখন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশীরা ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ শব্দটা আবিষ্কার করেছে মাত্র। প্রচুরসংখ্যক তরুণ রাজনৈতিক কর্মী বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যে যেভাবে পারে বিভিন্ন দেশে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে। পশ্চিম জার্মানীতে বেশকিছু তরুণ বিশেষ করে জাসদকর্মী পালিয়ে যায়। সেই সময় পুরো জার্মানীতে ২০-৫০ জন বাংলাদেশী হবে। তাদেরই একজন বাবু ভাই। তখন যেহেতু বাঙালী চারদিকে হাতে গোনা, তাই বাঙালী পেলে আনন্দই লাগত। বাবু ভাই জার্মানীতে কি করত জানিনা। তবে বছরে কয়েকবার বুলগেরিয়ার সীমান্ত পার হয়ে ‘মারসেডিস গাড়ি বিক্রি করতে ইস্তাম্বুল -সিরিয়া-ইরাক আসা যাওয়া করত। পুরোনো গাড়ি ভাল দামে বিক্রি করত। বুলগেরিয়া দিয়ে পার হওয়ার সময় সিনিয়র খোন্দকার ভাইয়ের রুমে আসত। খাওয়া-দাওয়া, গল্পকরত। সেই সুবাদে তার সাথে আমার দেখা ও পরিচয়। বেটে, ঝাকড়া চুল। জার্মানী থেকে চেকশ্লোভাকিয়া, অষ্ট্রিয়া, হাংগেরি যুগোস্লাভিয়া হয়ে গাড়ি চালিয়ে বুলগেরিয়ায় আমাদের সাথে একটু বিশ্রাম করত। তাদের এই গাড়ি বিক্রি করার ব্যবসাটা বেশ ২ নম্বরি ও রিস্কি। এতগুলো বর্ডার ম্যানেজ করা দূরহ বৈকি! মাঝে মাঝে তাকে বিভিন্ন জেলে যেতে হত। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে সে জেল খাটত প্রায়ই। কারণ গাড়ি করে বর্ডার ক্রস, আর ফিরতি পথে গাড়ি ছাড়া। পুরোনো গাড়ি বিক্রি করাই তার মূল ব্যবডা।

 

একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোন দেশের জেল সবচেয়ে ভাল? বাবু ভাই বলল, সুইজারল্যান্ডের জেল। প্রতি সকালে নাকি বাটার, ব্রেড, জুস দিত। বালিশ, বেডশীট নাকি প্রতি সপ্তায় চেনজ করত। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোন দেশের জেল সবচেয়ে খারাপ? বলল, ইরানের জেল। ইরানে নাকি প্রতি সকালে কথা-বার্তা ছাড়াই বন্দীদের আচ্ছা করে বেত মারত। আমাদের দেশে যাকে বলে ‘চামড়া তুলে ফেলা’র মত পিটুনি। জীবনের ও জীবিকার প্রয়োজনে কত বাঙালী কত কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে স্থিত হওয়ার চেষ্টা করে তার উদাহরণ বাবুভাই। হোস্টেল বদলিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়াতে তার সাথে আর দেখা হত না। কিন্তু বিচিত্র এই মানুষের বিচিত্র জীবন ও ব্যবসা আমি ভুলতে পারি নি।

 

অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ : এক অসাধারণ মানবচরিত্র বিশ্লেষণকারী রম্যলেখক। এপার-ওপার বাংলায় সমান জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিক। আমার সাথে যখন তার পরিচয় হয় তখন তার বয়স ৭০। আমার চেয়ে ৩০ বছর বড়। এক নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। উনার সাথে অসৌজন্য আচরণ এর কথা আমাকে বললে আমি আবার সেই শিক্ষিকার কাছে নিয়ে ব্যাপারটার রফা করি। আসলে অধ্যাপক সাহেবের বেশভূষা দেখে উনার গুন বোঝার উপায় ছিল না। অনেকটা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার খাবার পকেটে রাখার মত কাহিনি। ১৯৩৭-৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করা এই লোক পরবর্তীতে কমিউনিস্ট আন্দোলন করতে গিয়ে ২০ বছর পলাতক, আত্মগোপন জীবন যাপন করেন। কৃষক ও সাধারণ মানুষের মাঝে কাজ করতে গিয়ে মার্কসবাদকে জীবনব্রত করে নেন। তার কাঁধে থাকত একটা কাপড়ের থলে, শার্ট-প্যান্ট, হাটতেন ছাতা হাতে। বোঝার উপায় নেই যে এই লোক সরকারী কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনা করেছেন ১৪ বছর। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্বপাকিস্তান এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতি কেন করছেন তা তিনি জবাব দিয়েছেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর একটা উদ্ধৃতি দিয়ে। Enthusiasm is no good without equipment. অর্থাৎ শুধু সদিচ্ছাই রাজনীতির জন্য যথেষ্ট নয়, যোগ্যতা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতাও দরকার। ১৯৫৪ পরবর্তী যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের আন্তঃকলহ, করাচীর নেতৃত্বের বাংলার প্রতি অবজ্ঞা ও তৎপরবরতী সামরিক শাসন আসহাব উদ্দিন আহমদকে কমিউনিস্ট পার্টির কাতারে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কারাবাস, আত্মগোপন ও নেতৃত্বের কলহ তাকে রাজনীতি থেকে পুরোদমে সাহিত্যচর্চায় নিয়ে আসে। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি প্রান্তিক মানুষের সুখ দুঃখ দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে। দীর্ঘজীবনে তার উপলব্ধি, জনগণের ভালবাসা থেকে ভাল আর কোন টনিক নাই। ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তি এটমবোমার চেয়েও শক্তিশালী। জনতা হল ত্যাগী, বুরজোয়া নেতারা ভোগী এবং শ্রেণিগত স্বার্থে ওয়াদাখেলাপী। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে ধার, বিপ্লব বনাম অতি বিপ্লব, ইন্দিরা গান্ধীর ফাঁসী চাই, দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ, ভূমিহীন কৃষক কড়িহীন লেখক, Vonde votaram (ইংরেজি)। মোট ২৫টি প্রকাশিত ও চার-পাঁচটি অপ্রকাশিত বই আছে। ইন্দিরা গান্ধীর ফাঁসী চাইলেও বলা হয়ে থাকে তিনি নাকি এদেশ থেকে নিয়ে Vonde Votaram বইটা পড়েছিলেন। যা হোক মাঝেমধ্যে সকালে উনার খেয়ালী জীবনের গল্প শোনতাম। অভিজাত পরিবার, সরকারী কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে পাকিস্তান আমলে আত্মগোপনের জীবন বেছে নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করা, ভুল শুদ্ধ যাই হোক এক বিরল ঘটনা। তার রম্যসাহিত্য উদ্দেশ্যবিহীন রচনা নয়। শ্রেণিশোষণ আর বৈষম্যই তার সাহিত্যের উপজীব্য। তাই তার বইয়ের প্রথম পাতায় শেকসপিয়ার এর ‘পেরিকেলস’ প্রিন্স অফ টায়ারের দ্বিতীয় পর্বের প্রথম অংকের একটা সংলাপ থাকত- জেলে : কর্তা, মাছ পানিতে কি ভাবে বাচে? কর্তা : কেন? বড়রা ছোটদের গিলে খায়। চিকিৎসার জন্য ঢাকা যাওয়ার মুহূর্তে ও রম্য-কথন থেমে থাকেনি এই পৌরুষদীপ্ত মানুষের। বললেন, বয়স আমার আশি এবার তবে আসি। তার সাহচর্য একটা পরম প্রাপ্তি।

 

শিক্ষক নৃপেনদ্র নাথ দেব : এই স্যার আমাকে পাঁচবছর বাংলা ব্যাকরণ পড়িয়েছেন। আজকাল ব্যাকরণ চর্চা ও পড়া সংকুচিত। কিন্তু ব্যাকরণের মত একটা বিষয়ও যে গান-কবিতার মত উপভোগ্য হতে পারে নৃপেন স্যার আমাকে শিখিয়েছেন। যে বরণ স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না তাকে ব্যাঞ্জনবর্ণ বলে। কিন্তু কিভাবে স্বরবর্ণের সাহায্যটা হয় তা জানারও দরকার হয় না, জানাটা কোন কাজেও লাগে না। সেই বেদরকারি ‘কেন’টাই তিনি আমাকে শিখাতেন। ব্যাকরণের আরো কিছু জটিল বিষয় তিনি আমাকে শিখিয়ে বলতেন, এগুলো তুই আর আমি ছাড়া আর কেউ পরবে না। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিচার নিয়োগের পরীক্ষায় এসব প্রশ্ন করলে আসলেই কোন পরীক্ষার্থী পারত না। নৃপেন স্যার ব্যাকরণে অংকের হিসেবে নম্বর আশা করতেন। তার ছেলে গীতিকার ও বাংলার অধ্যাপক পংকজ দেব অপুকে কোনকিছু জানার জন্য জিজ্ঞেস করলে সে বলে, বাবা আমাকে পড়িয়েছেন, আর শিখিয়েছেন আপনাকে। এই শিক্ষক সুফলা মাঠের কৃষক। সহস্র প্রণাম সময়ের কথনে না-হারা নৃপেন স্যারকে।

 

ছোট দাদী: আমার আপন দাদী মারা যান বাবার বয়স যখন ৭ বছর। ছোট দাদী আমার সাথে শহরেই থাকতন। মারা যান ১০৪ বছর বয়সে। তার জন্ম রেংগুনে।উনার বাবা পেশোয়ার (পাকিস্তান) এর পাঠান। বৃটিশসেনা হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রেঙ্গুন যান। সেই সূত্রেই দাদীর রেঙ্গুনে বেড়ে ওঠা। তার মত তীক্ষ্ন বুদ্ধিমতি, চালাক, স্মার্ট মহিলা তখন কদাচিত মিলত। ফুফু বিমানবাহিনীর চাকরি সূত্রে পাকিস্তান থাকত। দাদীর তাই পাকিস্তান যেতে হত। একবার গেলে কয়েক মাস থাকত। করাচী, লাহোর, পেশোয়ার, কোয়েটা শহরেই ঘুরেফিরে থাকতে হত। তখন যে উর্দু চর্চা হত তা এদেশে এসেও ভুলত না। বাংলা পড়া কোত্থেকে শিখেছে জানি না। সারাদিন চশমা চোখে বই পড়ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বই পড়ত। চোখের চশমার চিকিৎসা করতেন কভিডে মৃত ডা. শহিদুল আনোয়ার থেকে। ডা. সাহেব যখনই বলতেন, দাদী বয়স হয়েছে তো, আর ভাল কেমনে দেখবেন? দাদী বলতেন, তোমাদের কাছে বুড়া মানুষের চোখের চিকিৎসা নাই? দাদারা চার ভাই। রেঙ্গুনের যৌথ পরিবার, যা পাকিস্তান-বাংলাদেশ আমলেও টিকেছিল। দাদী ছিলেন যৌথপরিবার এর হেড অফ ফ্যামিলি। যৌথপরিবারের একক ফুফু যৌবন বয়সে স্বামী হারান। সবাই যখন মৃতের কাফন নিয়ে ব্যস্ত, দাদী চিন্তা করল এই যোয়ান মেয়েকে তো আবার বিয়ে দিতে হবে। তাই সোনা অলংকার তো লাগবে। উনি আলমিরা থেকে সমস্ত সোনা গয়না নিয়ে অসুস্থতার ভান করে মরা বাড়ি থেকে চম্পট। এই গল্প এলাকায় বেশ চালু ছিল। আশেপাশের দু’চার গ্রামের জন্য উনি বড় বৈদ্য। বাচ্চা না হওয়া, পেটব্যথা, হরেকরোগের চিকিৎসার জন্য জনগণ দাদির শরণাপন্ন হত। দাদীর ফিসও ছিল বিচিত্র। শাড়ি, ঘরের কবুতর, পান-সুপারি ইত্যাদি। দাদির মাজার-প্রীতি অতিমাত্রায়। বাবা মারা যাওয়ার পর জমির বর্গাদাররা আমাকে যে টাকাই অফার করত দাদাী তা বাতিল করে বেশি দামে লাগিয়ত করত। বলত, নাতি আমার ডাকতারী ছাড়া আর কিছু বোঝে? ওর সাথে কিসের কথা? দাদি যেখানেই যাক কাধে এক ব্যাগ থাকত। কাউকে এই ব্যাগ ধরতে দিত না। একদিন এই ব্যাগ নিয়ে তিনি চোখ দেখাতে চক্ষুহাসপাতাল যায়। হঠাৎ এই ব্যাগ মেঝেতে পড়ে যায়। দেখা গেল, ব্যাগ থেকে ফ্যানের বাতাসে সব ৫০০, ১০০ টাকার নোট উড়তে থাকে। সব মানুষ হাসতে হাসতে শেষ। আমার আত্মীয়রা উনাকে যা টাকা গিফট দিত সব এই ব্যাগে রাখত।
আমি ঘরে মাছ-মাংস তরকারি যাই কিনতাম সব কিছুই দাদীর না-পছন্দ, হয়ত ফ্রেশ নয়, নইলে পঁচা ইত্যাদি। একদিন আমাকে বলল, হায়রে নাতি, ডাক্তারী ছাড়া আর কিছুই শিখলি না! চকবাজারের দোকাানীরা বসে থাকে কখন ডাকতার আসবে, পঁচা মাল বিক্রি করতে পারব! মোটামুটি আমার কোন কেনাকাটা তার পছন্দ হয় না। ২০১৪সালে আমার স্ত্রী দাদীকে বলল, তোমার নাতি রেংগুন যাচ্ছে, তুমি ও যাও। বুড়ি তিনদিন কান্না করেছে, মনে করেছে আমি তাকে রেংগুন রেখে আসতে প্ল্যান করছি। রেঙ্গুন থেকে ফিরে আসার পর আমাকে জিজ্ঞেস করল অমুক রোডে তোর দাদার অফিসে, বিভিন্ন জায়গা যা তার মনে আছে ওখানে গিয়েছি কিনা।জমকালো চরিত্রের মহিলা। ঘরেরও মুরব্বি, গোটা পাড়ারও মুরব্বি। সবার ছোট দাদী। নষ্টালজিয়া মানুষকে আনন্দ দেয়। সবসময় রেঙ্গুন, করাচীর স্মৃতিচারণ করত। অগুনিত পথিক জীবনের পথচলায়। সময়ের কথনে কেউ স্মরণে থাকে, কেউ হারিয়ে যায়। জীবনস্রোতের প্রবাহে কতজন, কত কথা নিয়েই সময়ের কথন।

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট