চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শারদীয় দুর্গোৎসব

ড. অনুপম সেন

৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:২১ পূর্বাহ্ণ

শারদীয় দুর্গাপূজা-উৎসব বাংলাদেশের অন্যতম একটি মুখ্য উৎসবের কাল, উৎসবের দিন। এই উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও এই উৎসবে সবাই আমন্ত্রিত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। বাংলাদেশের যে-অসাম্প্রদায়িক চেতনা ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র ও উৎসব সবার’, এই উৎসবে ফুটে উঠে।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সারাদেশে মহাসমারোহে পালিত হওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ পূজা দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব। এই পূজা দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ও গমন উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই ঘটে। শরতের এ বড় উৎসবকে তাই শারদীয় পূজা বলে ডাকা হয় বাঙালি হিন্দু সমাজে, যা একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

দেবী দুর্গা মৃন্ময়ী; মাটির মূর্তি হলেও বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গার রূপ অসুরদলনী কিংবা কন্যারূপেই অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। যে কন্যা প্রতি বছর একবার সপরিবারে আসেন পৃথিবীতে পিতা-মাতার সঙ্গে চার-পাঁচটি দিন একত্রে কাটাতে। ফিরে যান নিজ গৃহে। ঠিক যেভাবে আসে বাঙালি গৃহস্থবাড়ির কন্যা তার পিতা-মাতার বাড়িতে। দেবীকন্যার এই পিতৃগৃহে আগমনই শরতের দুর্গাপূজা।

শারদীয় দুর্গোৎসব মুখ্যত বাঙালির। বাংলাদেশের বাইরে এই উপমহাদেশের আর কোথাও এই উৎসবটি এত ব্যাপকভাবে ও বিচিত্ররূপে মহা আনন্দে ও আড়ম্বরে উদযাপিত হয় না। এই উপমহাদেশের অন্যত্র এই পূজার শেষ দিনটিই অর্থাৎ দশমির দিনটি ‘দশেরা’ নামে বিপুল উৎসাহে পালন করা হয়। বাঙালির দুর্গাপূজার একটি বাঙালিয়ানা রূপ রয়েছে ধর্মতাত্ত্বিক দিক ব্যতিরেকে; সেটি হলো এই দিনে মেয়ে বাপের বাড়ি আসে; তিনদিন পরে চতুর্থ দিনে আবার স্বামীগৃহে ফিরে যায়। বাঙালির কাব্যেও দুর্গা মা বাঙালির একটি সাধারণ মেয়ে হিসেবেই নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। ভারত চন্দ্রের কাব্যে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তাঁর স্বামী কে, তিনি শিবের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে:

অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ

কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন।

বাংলা সাহিত্যে এটি ব্যজস্তুতির এক আসাধারণ উদাহরণ। ‘অতি বড় বৃদ্ধ পতি’ বলতে বুঝানো হচ্ছে, তিনি বিশ্বের অধিপতি; ‘সিদ্ধিতে নিপুণ’ বলতে বুঝানো হচ্ছে, সবকিছুই তাঁর, সবকিছুতেই তিনি সিদ্ধ। ‘কপালে আগুন’ অর্থ তিনি সর্বশক্তিধর, ত্রিনয়ন বিশিষ্ট।

বাঙালি জীবনে কন্যার পিতৃগৃহে আসা এবং ফিরে যাওয়া দু’টিই একই সঙ্গে বিশাল আনন্দ ও বেদনার। দুর্গাপূজার অন্তে এই বেদনার রূপ খৃশ্চান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তও বর্ণনা করেছিলেন এভাবে: ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমি দিবসে’।

প্রতি বছর দুর্গাপূজা আসে শরতের মাঝামাঝি সময়ে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে এই ক’দিন বাঙালি আনন্দ উৎসবে মেতে থাকে। এই পূজায় ধর্ম যেমন একটি বড় বিষয়, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো সার্বজনীন কল্যাণ কামনা।

পৃথিবী এখন পুঁজি আর লাভের যুদ্ধে লিপ্ত। আলো আর আঁধারের লড়াই। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, দেশত্যাগ, যুদ্ধ, ভিন্নমত দমন ইত্যাদি এ জাতির  জীবনে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিকে খামচে ধরছে আঁধার-থাবা। এ আঁধার বিনাশে, এই তিমির বিনাশে অসুর শক্তির হাত থেকে প্রতীকী অর্থে দেবীর ধরাধামে আবির্ভাব সর্ব মানবের মঙ্গল বয়ে আনুক।

প্রফেসর ড. অনুপম সেন : সমাজবিজ্ঞানী; উপাচার্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট