চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অকাল বোধনের শারদ উৎসব

মৃন্ময়ী মূর্তিতে চিন্ময়ীর আরাধনা

সুখময় চক্রবর্তী

৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ

অকাল বোধনের শারদ উৎসব। মৃন্ময়ী মূর্তিতে চিন্ময়ীর আরাধনা। দুষ্টের দমনে ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র অকাল বোধনের মাধ্যমে দুর্গতি নাশিনী মা দুর্গার আরাধনা করেন। তাই আবহমান বাংলার জনপদে মা দুর্গা শারদীয়া রূপে পূজিতা হন। কালক্রমে এ পুজোই প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রেতপক্ষের পর দেবী পক্ষের সূচনা হলে শরতের শিশির ভেজা জনপদে দুর্গতি নাশিনী মৃন্ময়ী মূর্তি রূপে আবির্ভূত হন। পবিত্র ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম মতে প্রথম মানব আদমকেও মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয় এবং তাঁর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই পৃথিবীর সকল মানুষ মাটিকে মহাপবিত্র বলে গণ্য করে থাকেন। মাটিতেই সৃষ্টি, মাটিতেই লয়। সনাতন শাস্ত্রমতে মা দুর্গা জগৎজননী। বিশ^রূপা মহাশক্তি মহামায়া মা দুর্গা সকল দেবশক্তির প্রতীক।

অশুভ শক্তিকে বিতাড়ন করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার  জন্যেই মহামায়ার সৃষ্টি। শ্রী শ্রী চন্ডীতে তার বিশদ ব্যাখ্যা আছে। শ্রী শ্রী চ-ী মার্কেন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত। মহর্ষি বেদব্যাস এর প্রণেতা। পাঁচ সহস্রাধিক বছর পূর্বেও পাঞ্জাবের  হরপ্পা এবং সিন্ধু দেশের মহেঞ্জোদারো নগরে দেবী পূজা হতো। তাই এই প্রাচীন নগরদ্বয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে অসংখ্য মৃন্ময়ী দেবী মূর্তি পাওয়া যায়।

ইতিহাস খ্যাত গবেষকগণ ও প-িতগণ উক্ত মার্কে-েয় পুরাণের প্রাচীনত্ব প্রশ্নে একমত। পৃথিবীর সকল ধর্মেই অদ্বিতীয় ব্রহ্ম সত্তার কথা নানাভাবে ছন্দে-পদ্যে, গদ্যে কবিত্বে ও অভিব্যক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। শ্রী শ্রী চন্ডী তার অন্যতম। ব্রহ্মা নিরাকার এবং অদ্বিতীয়। ‘একো অহং বহুস্যাম।’ হিন্দু ধর্মে বহু দেবদেবী; কিন্তু তাদের পটভূমিকায় আছেন সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’। ঈশ^র এক ও অদ্বিতীয়। তবে, ঈশ^রের  শক্তি বহুমুখী। সেই জন্যেই ভিন্ন ভিন্ন শক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপাসনা করা হয়।  সাধক সাধনা করে মৃন্ময়ী মূর্তিতে কাক্সিক্ষত চিন্ময়ীর দর্শন পান। কালীরূপ চিন্তা করতে করতে সাধক কালীরূপেরই দর্শন পান। তাই রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ প্রমুখ কালী শূর্তির মহাসাধকগণ পুনঃ পুনঃ বলেছেন, যিনি কালী, তিনিই ব্রহ্ম। এই সারতত্ত্বই হিন্দুধর্মের‘বহুরূপে একেশ^রবাদ।’  মাতৃশক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়শক্তি,  আদিশক্তি। ‘সহ¯্রং তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে’ (মনুস্মৃতি ২/১৪৫) অর্থাৎ মায়ের স্থান পিতার চেয়ে হাজার গুণ অধিক। ‘মা’ শব্দ উচ্চারণ করলে যে ভাব উৎপন্ন হয়, অন্য শব্দ উচ্চারণ করলে সেই ভাব উৎপন্ন হয় না। সে জন্যে শঙ্কারাচার্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেও মা বলে ডেকেছেন ‘মাতঃ কৃষ্ণাভিধানে (প্রবোধ, ২৪৪)। উপনিষদে মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব’ বলে সকলের আগে মাকে সেবা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। অখ- ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের মর্মস্পর্শী ও ঐতিহাসিক উচ্চারণ বন্দে মাতরম’ এতেও মাকে বন্দনা করা হয়েছে। জগতের সকল নারীশক্তিকে মাতৃশক্তির রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে – বিদ্যাঃ সমস্তাঃ তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ জগৎসু’ (শ্রীশ্রী চ-ী ১১/৬) অর্থাৎ হে দেবী সকল বিদ্যা আপনার অংশ, জগতের সকল স্ত্রীগণই তথা নারীগণই আপনার বিগ্রহ। কিন্তু অখ- ভারতবর্ষের শত সহ¯্র মুনি-ঋষি-সাধক-সন্ন্যাসী মহাপুরুষদের সাধনা লব্ধ ও জ্ঞান লব্ধ বাণী নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে অখ- ভারতবর্ষের কোন কোনঅঞ্চলে উরাড়ৎপব বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথা প্রচলন করে নারী নির্যাতনের যে সহিংস প্রবণতা চালু করা হয়েছে তা ভয়াবহ এবং সনাতন ধর্মের আদর্শ পরিপন্থী।

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আইন জারি করে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথা চালু করায় সেখানে বর্তমানে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের যেই নির্মম কাহিনী ঘটছে এবং যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়তে গল্প কাহিনী হিসেবে ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে তা চরম দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। এতে ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক সুবৃহৎ ভারতের ভাবমূর্তি অনেকাংশে বিনষ্ট হচ্ছে বললে ভুল হবে না। এই রাজ্যে আইন বলে নারীদের সমান ভূমি অধিকার প্রদান করে অর্থাৎ পৈত্রিক ভূমিতে নারীর অধিকার সুরক্ষা করে সরকার যেই সুনাম অর্জন করেন, বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথা ও বিবাহ নিবন্ধন প্রথা চালু করে সেই সুনামকে অনেকটা খাটো করা হয়েছে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন।  বিবাহ নিবন্ধনসুখী জীবনের সেতু বন্ধন নয়। এরকম ভাবা অনুচিত হবে না।  মাথায় প্রচ- ব্যথা করে বলে মাথাকে কেটে ফেলা হয় না।  ওষুধ দিয়ে তা সারাতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বিষয়টি ঐতিহ্যগতভাবে ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। নারীর প্রতি প্রতিনিয়ত ঘৃণ্য অসম্মান প্রদর্শণ করে ও নারীকে উচ্ছিষ্ট মনে করে আদ্যাশক্তি মহামায়া মা দুর্গার আরাধনা করা নিরর্থক। স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ের মায়ের আকুতি ও যন্ত্রণা, পিতার বুক ফাটা হাহাকার এবং ভাই বোনদের অস্থিরতা বড়ই বেদনাদায়ক। সনাতন ধর্ম উদার, প্রগতিশীল ও মানবিক ধর্ম।  এ ধর্মের সহিংসতার আশ্রয় নেই। বলতে গেলে কোন ধর্মেই সহিংসতার কোন আশ্রয় নেই।  সকল ধর্মই শান্তির পথপ্রদর্শক।  যিনি বুঝেন – তিনি জানেন। যিনি বুঝেন না তিনি জানেন না।

হিমালয় থেকে বিন্ধ্যাচল।  দেবাদিদেব মহাদেব হিমালয় পুরুষ, কৈলাশ পতি এবং আদ্যশক্তি মহামায়া দুর্গা বিন্ধ্যাচল বাসিনী, হিমালয় নন্দিনী।  প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, শাস্ত্রীয় সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর ও কলির নিদর্শন সমৃদ্ধ ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ এবং মন্দাকিনী মন্মথ কম্পা নদী ও সাগর বিধৌত সীতাকু-ের শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথধাম (চন্দ্রনাথ পর্বত) হিমালয় ও বিন্ধ্যাচলের শাস্ত্রীয় অংশ। তাই শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথধাম একদিকে মাতৃপীঠ, অন্যদিকে শিবালয়, শিব মহাপীঠস্থান। কলি তীর্থ, জাতীয় মহাতীর্থ। পুরাকাল থেকেই শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথধামে পূজিত হচ্ছেন মা দুর্গা, দশভূজা। পূজিত হচ্ছেন মা ভবানী। সতীরদক্ষিণ বাহু পতিত হয় চন্দ্রনাথধামে। মহাসাধক গোরক্ষনাথের সাধনাস্থল মহেশখালীর ঐতিহাসিক মৈনাক পর্বতে স্থিতমহাপীঠস্থান শ্রী শ্রী আদিনাথধামে আদ্যাশক্তি মহামায়া অষ্টভূজা রূপে পূজিতা হন।  সেখানে অষ্টভূজা ব্যতীত মৃন্ময়ী মূর্তিতে দশভূজা মা দুর্গার আর কোন পূজা হয় না।  অন্যত্র ঘট পূজা হয়।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানাধীন করলডেঙ্গা পাহাড়ে অবস্থিত মেধস আশ্রমে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের আগমন এবং সেখানে আদ্যাশক্তি মহামায়া মা দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে দুর্গা পূজা প্রচলন করার বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। কারণ, কোন কোন ধর্মীয় বক্তা করলডেঙ্গা পাহাড়ের আশ্রমকে শ্রী শ্রী চ-ীতে বর্ণিত সেই পুরাকালের মেধস আশ্রম বলে আখ্যায়িত করেন এবং রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য সেখানে দুর্গা পূজার প্রচলন করেন বলে বিশ^াস করেন। চ-ীতে বর্ণিত আছে – ‘ইতি তস্য বচঃ শ্রুতা, সুরথ স নরাধিপঃ। প্রণিপত্য মহাভাগং, তম্ ঋষিং সংশিত ব্রতম॥ নির্বিণেœা অতি মমত্বেন, রাজ্য অপহরণেন চ। জগাম সদ্যঃ তপসে, স চ বৈশ্যা মহামুনে। সন্দর্শন-অর্থম অম্বায়া, নদী পুলিন সংস্থিতঃ। স চ বৈশ্যাঃ তপঃ তেপে, দেবী-সুক্তং পরং জপন। তৌ তস্মিন পুলিণে দেব্যাঃ, কৃত্বা মূর্ত্তিং মহীময়ীম। অর্হণাং চক্রতুঃ তস্যাঃ,পুষ্প-ধূপ-অগ্নি তর্পণৈঃ॥ (শ্রীশ্রী চ-ী ১৩/৭-১০) অর্থাৎ রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য জগন্মাতারা সম্যক দর্শন লাভের নিমিত্তে নদী পুলিনে মহামায়ার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করতঃ পুষ্প, ধূপ, দীপ নৈবেদাদি দিয়ে পূজা করেন।

পরিশেষে বলতে হয় – ‘তয়া এতৎ – মোহ্যতে বিশ^ং, সৈব বিশ^ং প্রসূয়তে। সা অযাচিত চ বিজ্ঞানং, তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছিত। (শ্রী শ্রী চ-ী ১২/৩৭) অর্থাৎ বিশ^ ব্রহ্মা- এই দেবী (আদ্যশক্তি মহামায়া) কর্তৃক সৃষ্ট। তাঁর দ্বারা এই জগৎ মোহাচ্ছন্ন।  তিনি তুষ্ট হলে আত্মজ্ঞান ও ঐশ^র্য্য প্রদান করেন। ‘সৈব কালে মহামারী, সৈব সৃষ্টি : ভবতি অজা-স্থিতিং করোতি ভূতানাং, সৈব কালে সনাতনী।’ (শ্রী শ্রী চ-ী ১২/২৯) অর্থাৎ সেই সনাতনী দেবীই তথা আদ্যশক্তি মহামায়া মা দুর্গাই সৃষ্টি কালে ব্রহ্মা, স্থিতিকালে বিষ্ণু এবং প্রলয়কালে শিব।  বিশ^জনীন আদ্যাশক্তি মহামায়া মা দুর্গাকে আমি প্রণাম করি।  যা হোক, শারদ উৎসব বাংলাদেশের সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ এ উৎসব আজ সার্বজনীন উৎসবে রূপ লাভ করেছে। বলতে হয় ঈদ পুজোতে আমরা সবাই  পরস্পরের সাথী, আমরা সবাই একাত্তরের বীর বাঙালি জাতি।

সুখময় চক্রবর্তী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ সাংবাদিক, শিশু সাহিত্যিক ও এডভোকেট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট