চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অষ্টম কলাম

শারদ উৎসব আনন্দ জাগায় প্রাণে

এস প্রকাশ পাল

৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:১৬ পূর্বাহ্ণ

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পাঁচদিনব্যাপি দুর্গোৎসবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দশভূজার রাঙা চরণে তাদের মনোবাসনা পূরণের আকুল প্রার্থনা জানান। সকলে চান মহামায়ার কাছে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু।

দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকলেই এই আনন্দ আয়োজনে অংশ নেন বলে দুর্গাপূজার নামকরণ হয় সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব। ধনী-গরীবের ভেদাভেদ ভুলে ম-পে ম-পে তাই চলছে এখন আনন্দময়ীর আগমনী সুমধুর সংগীত।

শরৎকালের দুর্গোৎসব শুধু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য বাণিজ্য, বিদ্যাচর্চা, সামাজিক প্রীতির বন্ধন, হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমন্বয় সাধন করে শারদ উৎসব। সকল দেশের মানুষকে আপন করে নিতে শারদোৎসব বিশ্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে।

ত্রিনয়নী মা দুর্গাপূজার ইতিহাস বেশ পুরনো। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টির আদিতে গোলকের আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসম-লে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়ের নিধনে তিনি শরণাপন্ন হন দেবীর। ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধকালে সংকটাপন্ন মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপর দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র দুর্গাপূজা করেন। এটা চতুর্থ দুর্গোৎসব। দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মা ও ইন্দ্রের ন্যায় ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মা-ব্য, হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারে সুরথ রাজা ও বৈরাগ্য লাভের জন্য সমাধি বৈশ্য, কার্তবির্জাজুন বধের জন্য বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন।

দুর্গা ও দুর্গাপূজা সংক্রান্ত কাহিনীগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও লোকমান্য হল দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত কাহিনী। দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রকৃতপক্ষে ‘মার্ক-েয় পুরাণ’ এর একটি নির্বাচিত অংশ। সাতশত শ্লোকবিশিষ্ট এই দেবীমাহাত্ম্যই শ্রীশ্রী চ-ী গ্রন্থ। চ-ীপাঠ দুর্গোৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও বটে। দেবীমাহাত্ম্যম্-এর কাহিনী অনুসারে পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশ বছরব্যাপি এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। শান্তিপুরী স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই  ক্রোধে তাদের মুখম-ল ভীষণাকার ধারণ করে। ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সুউচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। তিনিই শ্রীদুর্গা। দৈত্য, বিঘœ, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা।

মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি। আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশ হাত দশ দিক রক্ষা করার প্রতীক, দশ প্রহরণ এক দেবতার সাধনালব্ধ বিভূতি। দেবী ত্রিভঙ্গা-ত্রিগুণাত্মিকা শক্তির প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী-একটি নয়ন চন্দ্রস্বরুপ, একটি সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর-দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক।

কাম, ক্রোধ, লোভ,  মোহ, মদ, মাৎসর্য এর ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বপুরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী-ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শুভ্র শক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রাহ্মণ্য শক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক।

সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ কল্পনা। তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র সুশোভিত। তার ডান হাতে ত্রিশূল, খড়গ ও চক্র; বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘন্টা। দুর্গা দেহ-দুর্গের মহাশক্তি। সাধক সাধনাকালে সেই শক্তিকে জাগ্রত করেন। সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূত করার জন্য উদ্যোগী হয়। সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাঁধে সংঘর্ষ। সেই অনন্ত জগতের সংঘর্ষের একটি প্রতীকী রুপ শ্রী শ্রী চ-ীর মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে।

এস প্রকাশ পাল  : প্রকাশক, মাসিক জ্যোতির্ময় (সনাতনী কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের স্মারক)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট