চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কালান্তরে দৃষ্টিপাত

সৌদি মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে হজ : প্রসঙ্গকথা

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানকালে পবিত্র মক্কায় হজ কার্যক্রম সৌদি মোয়াল্লেমগণের নিয়ন্ত্রণে। ওজারাতুল হজ ও ওমরা তথা সৌদি হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয় এ মোয়াল্লেমগণের নিয়ন্ত্রক।

মোয়াল্লেম অর্থ শিক্ষক বা শিক্ষাদাতা তথা জ্ঞানী। বিশেষ করে হজ বিষয়ে। হজযাত্রীগণের সেবায় এ মোয়াল্লেম পেশা শত হাজার বছর বা তারও আগে থেকে বলা যেতে পারে। সেকেলে প্রতিকূল যোগাযোগ, অনুন্নত জীবন যাপন অবস্থায় পবিত্র মসজিদুল হারমের নিকটে মোয়াল্লেমগণ সেকেলে নিয়মে ব্যবস্থাপনা রেখে হজ মৌসুমের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। হজযাত্রী পেলে তাদের থাকার ব্যবস্থাসহ রান্না করে খেতে সহযোগিতা দিতেন। পাঁচ দিনব্যাপী হজ কার্যক্রম তথা মিনা, আরাফাতে  মোয়াল্লেমেরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে হজযাত্রীগণকে অবস্থানের ব্যবস্থা করতেন।

ব্রিটিশ আমলত বটেই সে পাকিস্তান আমলে সৌদি মোয়াল্লেমগণ এ অঞ্চল সফর করতেন। চট্টগ্রামে আসতেন। উদ্দেশ্য হজের সময় হজযাত্রীরা যাতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। যেহেতু সেকালে মোয়াল্লেমগণের আয়ের প্রধান উৎস হজ্ব। সেই পাকিস্তান আমলে যে সমস্ত মোয়াল্লেমগণ আসতেন তাঁদের মধ্যে হাসান মুরাদ, ঈছা ছালেহ, আহমদ রমজান, মাতুক কোরবান অন্যতম। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ধনীদের ঘরে দাওয়াত খেতেই থাকতেন। আতিথেয়তা মানুষকে খাওয়ানো চট্টগ্রামের ঐতিহ্য।

সেকালে হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকারের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। হজযাত্রী থেকে করসহ বিভিন্নভাবে আয় রোজগার করত মাত্র। সেই ব্রিটিশ আমলে মুম্বাই থেকে অনিয়মিত ছোট ছোট জাহাজে করে ঝুঁকি নিয়ে ইয়ালামলাম পরবর্তীতে জেদ্দা বন্দরে পৌঁছতেন। জেদ্দা সমুদ্র বন্দর থেকে পবিত্র মক্কা ছিল ৩ মঞ্জিল তথা ৩ দিন ৩ রাতের পথ। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার মধ্যে যাতায়াতে ১৩ মঞ্জিল তথা ১৩ দিন ১৩ রাতের সময়ের ব্যাপার। দিনে বিশ্রাম রাতে যাতায়াত। টাকার বিনিময়ে উটে করে বা পায়ে হেঁটে।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আমলে তথা ১৯৭০ এর দশকেও সৌদি সরকার শুধু আয় রোজগার করত। হজকে তেমন নিয়ন্ত্রণ করত না। যাবতীয় আয়োজন মোয়াল্লেমরাই করত। মোয়াল্লেমগণ পবিত্র মক্কায় দালান ভাড়া করে রাখত। মিনা, আরাফাতে যাতায়াতের জন্য গাড়ি এবং ছোট ছোট তাঁবুর ব্যবস্থা করত। মাটি খুড়ে পর্দা দিয়ে টয়লেট তৈরি করা হত। হজযাত্রীগণের মধ্যে একটি  উল্লেখযোগ্য অংশ টাকা সাশ্রয় করার জন্য মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে না গিয়ে ব্যাগ কাপড় চোপড় নিয়ে মসজিদুল হারমে অবস্থান নিত। পবিত্র মক্কার নিকটে বিভিন্ন মসজিদে রাস্তার ধারে অসংখ্য হাজী অবস্থান করত। বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশের গরীব দেশের হাজীরা। পবিত্র মক্কায় বলদিয়া তথা মিউনিনিসিপিটি/পৌরসভার তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যথেষ্ঠ ঘাটতি ছিল। ১৯৮০ দশক থেকে সৌদি সরকার হজকে নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করে। সর্বপ্রথম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পাসপোর্ট-এ। হাজীরা সৌদি আরবে প্রবেশ করতেই পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। হজযাত্রীগণকে মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য করা হয়। এভাবে প্রায় ২০ বছর চলার পর সৌদি সরকার হজের আইন নিয়ম শৃংখলার ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা অবলম্বন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হজকে নিয়ন্ত্রণে নিতে এজেন্সী তথা সংস্থা করতে বার্তা পাঠানো হয়।

ওজারাতুল হজ ও ওমরা তথা হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় করা হয়। ওজারাতুল হজের নিয়ন্ত্রণে মোয়াল্লেমগণকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। পবিত্র মদিনায় হাজীগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আদিল্যা অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওজারাতুল হজ একাধিক টিকাদারের মাধ্যমে হজযাত্রী পরিবহনে বাস নিয়ন্ত্রণ, মিনা ও আরাফাতে হজযাত্রীগণের অবস্থানে তাঁবু, টয়লেটসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করে থাকে।

বিদেশী হাজীগণকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে নিলেও সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ মুসলমানগণ হজ করা উন্মুক্ত ছিল। ফলে ১৯৯০ ও ২০০০ এর দশকে ৩০-৪০ লক্ষ নর-নারী হজ করত। তৎমধ্যে একটি বড় অংশ সৌদি আরবের বিভিন্ন শহর থেকে আসত। পবিত্র মক্কাসহ জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, অর্থাৎ বড় বড় শহরসহ সারা সৌদি আরব থেকে লাখ লাখ প্রবাসী হজ করতে চলে আসত। তারা পবিত্র মক্কায় যে কোন স্থানে এবং মিনা ,আরাফাতে তাঁবুর বাহিরে অবস্থান নিত। অবস্থান নিত পায়ে হাঁটার সেটগুলোতে। অপরদিকে, সৌদিরা গাড়ি নিয়ে, পরিবার নিয়ে হজ করতে আসত। গাড়ির উপরে বা পেছনে ছোট তাঁবু, কম্বল, চাদর রান্না করার সরঞ্জাম থাকত। যাতে ৫/৬ দিনব্যাপী হজ করতে সুবিধা হয়।

কিন্তু প্রায় ২০১০ এর পর থেকে সৌদি সরকার তাও বন্ধ করে দেয়। সৌদিরা বা প্রবাসীরা যে কেহ মোয়াল্লেম বাদ দিয়ে স্ব উদ্যোগে হজ করতে পারবে না। আবেদন করে তালিকাভুক্ত হয়ে মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে হজ করতে হবে অনেকটা বিদেশীগণের মত। ফলশ্রুতিতে গত ৮/১০ বছরের ব্যবধানে হজযাত্রীর সংখ্যা দ্রুত নেমে আসে। গত ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের তথ্য মতে সৌদি স্থানীয়রা হজ করে ৬ লাখ ১২ হাজার। বাকী ১৭ লাখ ৫৮ হাজার বিদেশীসহ ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৬ শত ৭৫ জন নর-নারী হজ করেন। উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলি সৌদি আরবে আসতে ভিসা লাগে না। ফলে যে কোন সময় ওমরা করতে আসতে পারবে। কিন্তু হজ করতে হলে অন্যান্য দেশের মত নিয়ম মেনে আসতে হবে।

হজযাত্রীর সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে প্রায় ২৪ লাখে নেমে আসলেও এখনও হজ কার্যক্রম কষ্টসাধ্য। মোয়াল্লেমকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- এ,বি,সি,ডি। এ ও বি ক্যাটাগরির মোয়াল্লেমগণ অনেকটা মিনার মাঝে জমরাতের নিকটে। সরকারী হাজী ও চট্টগ্রামের মেয়র কাফেলা অতিরিক্ত টাকা দিয়ে এখানকার এ বা বি মোয়াল্লেমের মাধ্যমে হজ করে। সৌদিসহ বিশ্বের ধনীরা ১০/২০ হাজার অথবা ৪০/৫০ হাজার রিয়াল করে প্রদান করে মিনায় মোয়াল্লেমের মাধ্যমে বিশাল এরিয়া নিয়ে অতি আরাম আয়েশে হজ করে থাকেন। ফলে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ গরীব দেশের হাজীরা মিনার দক্ষিণে মুজদালফায় অথবা মিনার পাহাড়ের পূর্ব দক্ষিণে গিয়ে কম টাকায় ডি ক্যাটাগরিতে হজ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ১ লাখ ২৭ হাজারের মধ্যে ১ লাখ ১৮/১৯ হাজার হাজী ডি ক্যাটাগরিতে কম টাকা দিয়ে হজ করতেছেন।

সৌদি মোয়াল্লেমের সাথে মতবিনিময়: আল-হেরা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর মাধ্যমে হজে গমন করি। হজ মহান আল্লাহ পাকের কাছে ধর্মীয় উৎসব। কেন জানি মন থেকে তাড়িত হই এ উৎসবে গমন করতে।

আল-হেরা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসকে বেছে নিই এই ধর্মীয় উৎসবে গমন করতে। মালিক তথা এম.ডি ¯েœহের মোরশেদুল আলম চৌধুরী। তার মাধ্যমে সৌদি মোয়াল্লেম আমার সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। হয়ত মোয়াল্লেমের আগ্রহ আমার সাথে পরিচিত হতে। ১০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরার ফ্লাইট। এর মাত্র ২ দিন আগে ¯েœহের মোরশেদ অতি আগ্রহ করে আমাকে মোয়াল্লেম অফিসে নিয়ে যায়। প্রায় ৪০ এর কাছাকাছি বয়সের মোয়াল্লেমের নাম ইঞ্জিনিয়ার আবদুলরহমান ফয়সল বদর। তার লাইসেন্স নাম্বার ১২৩। আরবির পাশাপাশি ইংরেজিও বলতে পারেন। তার পিতা ও দাদা মোয়াল্লেম ছিলেন। তার মরহুম দাদা সেই সময় এই অঞ্চলে সফর করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। তার নিয়ন্ত্রিত ৪ হাজার হাজী সবাই বাংলাদেশী। মিনা ও আরাফাতে ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনিও আমার সাথে একমত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, জায়গা সীমিত। হজ মন্ত্রণালয় বেশি এরিয়া দিতে পারতেছে না। ফলে হাজীরা কষ্ট পাচ্ছে। হজ কার্যক্রমে ৪ দিন মিনায়। সে অনুপাতে টয়লেট অপ্রতুল। ফলে প্রতি দরজায় ৪/৫ জন অথবা ৫/৭ জন হাজীকে লাইন ধরতে হয়। হজ মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদার প্রতি হাজীর জন্য ছোট একটি বেড, বালিশ চাদর দিলেও তা প্রস্থে এত ছোট যে, একজন মানুষের জন্য যথাযথ নয়। ফলে মিনায় অবস্থান করা এবং টয়লেট ব্যবহার করা হাজীগণের জন্য খুবই কষ্টকর। মোয়াল্লেম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার সাথে একমত পোষণ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলেন। তাঁর সহকারী সহ চা-নাস্তা আতিথেয়তার পাশাপাশি আরও কিছুক্ষণ আলাপ করে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে মসজিদুল হারমে মাগরিবের নামাজ পড়তে চলে আসি।

বর্তমানে ২৪ লাখ নর-নারী হজ করছে। তৎমধ্যে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ ৬ লাখ নর-নারী বাদ দিলে বিদেশী হজযাত্রী ১৮ লাখ দাঁড়ায়। তারপরেও ১৭ লাখ তথা ১ মিলিয়ন ৭০ হাজার বিদেশী নর-নারী হজ করতেছে। হজ এজেন্সীর মাধ্যমে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিভিন্নখাতে এবং হজযাত্রী নগদে হিসেবে প্রতি হজযাত্রীর মাধ্যমে ২ হাজার মার্কিন ডলার তথা বৈদেশিক মুদ্রা সৌদি সরকার পাচ্ছে মনে করি। এতে ১৭ লাখ তথা ১ মিলিয়ন ৭০ হাজার হজযাত্রীর মাধ্যমে প্রতি বছর হজ উপলক্ষে সৌদি সরকার বৈদেশিক মুদ্রা প্রায় ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার পাচ্ছে।

তারপরেও হজ এজেন্সীগুলো ঘর ঠিক করতে, মোয়াল্লেম নির্ণয় করতে, বাসসহ সৌদি সরকার বিভিন্ন খাতে মোট প্রদেয় টাকার উপর ২৫%-৩৫% ট্যাক্স নিচ্ছে। তার উপর দুই পবিত্র নগরীতে হজ্বযাত্রীগণের জরুরি কেনা-কাটা, দুধ, পানি, দধি তথা জরুরি সামগ্রি কিনতে গিয়ে ৫% ট্যাক্স নিচ্ছে। সৌদি আরবেব অন্যান্য অঞ্চলের এবং পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার আইন এক হতে পারে না। এটি হজ ও ওমরাকারীদের শহর।

সৌদি সরকার শুধুমাত্র প্রতি বছর হজ উপলক্ষে প্রায় ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার পাচ্ছে সেখানে সৌদি সরকার হাজীদের থেকে যাবতীয় ট্যাক্স, ভ্যাট প্রত্যাহার করা অত্যাবশ্যক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট