চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অষ্টম কলাম

দুর্গাপূজা ও সমাজসম্প্রীতি

৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতি শরৎকালে বাঙালী সনাতন সম্প্রদায়ের বাড়িতে বাড়িতে উৎসবের আমেজ। কারণ মা দুর্গা কৈলাস থেকে মর্ত্যকুলে নেমে আসেন। মায়ের আগমনে মন্ডপে মন্ডপে মাংগলিক আওয়াজে মুখরিত। কেউ ফুল তোলার কাজে ব্যস্ত, কেউ মায়ের পূজার জন্য দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে ব্যস্ত। ছোট শিশুরা এক মন্ডপ থেকে আরেক মন্ডপে ছুটে চলার জন্য মায়ের কাছে আবদারের বার্তা নিয়ে ছুটে আসে।

সনাতন ধর্মের যারা অনুসারী তারা একে অপরের সাথে মহামিলনের এক অপুর্ব প্রচেষ্টায় রত থাকে। কারণ মা আসেন মিলনের বার্তা নিয়ে। পূজার আয়োজক থাকেন হিন্দু সম্প্রদায়। কিন্ত সাজসজ্জা, সাউন্ড, লাইটিং এর কাজে নিয়োজিত থাকে অন্য সম্প্রদায়। সবাইকে নিয়ে কাজ করার এক শিক্ষা মাতৃপূজায় পেয়ে থাকি। এই পূজা সুর শক্তিকে জাগ্রত করার শিক্ষা দিয়ে থাকে।

সুর মানে শুভ শক্তি আর অসুর মানে অশুভ শক্তি বুঝি। বলতে গেলে সুর অসুরের সংঘাত আমরা প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি। এই সংঘাত আমরা দেখি মাতৃ পূজার কাঠামো বিন্যাসে। দেবতারা শুদ্ধ শক্তিতে শক্তিমান ছিল। কিন্তু তারা তা ভুলে গিয়েছিল।

যার কারণে তাঁদের উপর পরীক্ষা নেমে আসে। দেবতাগণ অসুর কর্তৃক পরাজিত হয়ে রাজ্য হারা হন। রাজ্যচ্যুত দেবতাগণের সম্মিলিত প্রার্থনার ফল হিসেবে মা দুর্গার শুভাগমন। সর্বমঙ্গলা মা দুর্গার কাছে জগতকে যিনি উগ্রভাবে কামনা করতেন তার প্রতীক মহিষাসুর পরাজিত হন। মহিষাসুর নারীরূপী মহাশক্তি দেবীকে ভোগ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।

উক্ত ভোগেচ্ছা অসুরের পরাজয়ের আরেকটি কারণ। আমরাও বাস্তব জীবনে যদি শুভ শক্তির মিলন ঘটাতে পারি তাহলে সকল অশুভ অহংকারী শক্তি আমাদের পদানত হবে। সকলকে নিয়েই সমাজে থাকতে হয়।  দেবী কাঠামোতে আমরা দেখতে পাই মা দুর্গার সাথে জ্ঞানদাত্রী সরস্বতী, ধনদাত্রী লক্ষী, দেবসেনা কার্তিক, সিদ্ধিদাতা গণেশ, মঙ্গলময় শিব ও কৃষি আর শিল্পের প্রতীক কলা বৌ। শক্তিময়ী মা মঙ্গলময় শিবকে মাথায় ধারণ করার শিক্ষাটি আমাদের জন্য এক অনুপম বার্তা প্রদান করেছে।

অনেকে সময় আমরা অর্থ বিত্তের মধ্যে খুব বেশি দিনাতিপাত করি। আমরা ভুলে যাই মানুষের মঙ্গল কামনার পবিত্র শিক্ষাটি। আমরা অনেক শক্তিশালী হতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দেহগত শক্তি আর আর আর্থিক শক্তি একদিন শেষ হয়ে যাবে। তাই আমাদের উচিত শক্তিকে মংগলের কাজে নিয়োজিত করা।

মাতৃপূজা নারী জাতিকে সম্মান জানানোর শিক্ষা প্রদান করে। একদিকে ভোগবাদী কিছু মানুষের অতি বাড়াবাড়ির কারণে সভ্রম হারাচ্ছে নারী জাতির বিশাল অংশ। অন্যদিকে উগ্রবাদী কিছু মানুষের কাছে পরাজিত হচ্ছে আমাদের মানবতা। মানবতার মহাশক্তিকে জাগ্রত করে দুর্গত মানুষের দুর্গতি নাশ করার মানসে প্রতিবছর মহাসমারোহে আমরা মাতৃপূজার আয়োজন করি। কারণ মা দুর্গা হচ্ছেন দুর্গতিনাশিনী। দুর্গা নামের মাঝেও তাৎপর্য আছে। যেমন – দ = দৈত্য নাশ উ = বিঘœ নাশ  র = রোগ নাশ গ = পাপ নাশ আ = ভয় ও শত্রু নাশ

অতএব মা দুর্গা হছেন দৈত্য, বিঘœ, রোগ পাপ, ভয় ও শত্রু নাশিনী। দেবী দুর্গা শুধু মুর্তিতে অথবা মন্দিরে নন। তিনি সর্বত্র বিরাজিতা।

মায়ের পূজার উপকরণের দিকে থাকালেও সম্মিলিত সমাজ সৃষ্টির আরেকটি শিক্ষা আমরা পেয়ে থাকি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে ঐক্য, সম্প্রীতির বন্ধনে সমৃদ্ধ হওয়ার মানসে আমরা মায়ের পূজা করি সেই ঐক্য আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পারছি। বিভিন্ন জায়গায় চলছে ধর্মের নামে অধর্ম, পূজার নামে ব্যবসায়, ত্যাগের বহিরাবরণে চলছে বিলাস সামগ্রীর আধিক্য। অনেক টাকা খরচ করে মায়ের পূজা করছি মায়ের কৃপা লাভ করার জন্য।  কিন্তু মায়ের কৃপা পাওয়ার আরেকটি বড় উপকরণ ঘরের মাকে সঠিকভাবে শ্রদ্ধা করছি কিনা সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

পূজার সার্থকতা আরো বেশি করে আমাদের সামনে আসবে যদি আমরা মাতৃজাতির উপর সঠিক সম্মাননা জানাতে পারি। একে অপরের সাথে মহামিলনের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি। সমস্ত অশুভ শক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে শুভ শক্তির জয় হোক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট