চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

মহাত্মা গান্ধী : শান্তি ও অহিংসার জন্য নিবেদিত জীবন

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:১০ পূর্বাহ্ণ

২০১৯ সালের ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মের ১৫০ বছর। তার দুই দিন আগে আমি দিল্লি সফরের সময় উপস্থিত হয়েছিলাম গান্ধী সমাধিস্থল ‘রাজঘাট’-এ। বৃক্ষ ও পুষ্প শোভিত ‘রাজঘাট’ শান্তি ও অহিংসার আবহ তৈরি করলেও বাস্তবে উপমহাদেশ জুড়েই সংঘাত ও হানাহানি চলছেই।

মৌলবাদ ও মানবতাবিরোধীদের হাতে জীবন দিয়েও গান্ধী দমে যান নি। তিনি জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত শান্তির অন্বেষণ করেছিলেন। শান্তি ও অহিংসা তাই গান্ধী জীবনের মূলমন্ত্র রূপে উদ্ভাসিত। তপোবন-সদৃশ্য ‘রাজঘাট’-এ দাঁড়িয়ে আমি মহাত্মা গান্ধীর জীবনের শেষ দিনগুলোর স্মৃতি খুঁজছিলাম। আর তা ছিল ১৯৪৭ সাল, যে বিশিষ্ট বছরটি ছিল অবিভক্ত ভারতের শেষ বছর। একই সঙ্গে বছরটি ভারতের জাতীয় নেতা মহাত্মা গান্ধীর জীবনেরও শেষ অধ্যায়।

ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের আগের বছরটিও (১৯৪৬) ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা ও উত্তাপে ভরপুর। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তার রেশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গা নিবারণে গান্ধী দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বাংলার নোয়াখালিতে পৌঁছেছিলেন ১৯৪৬ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
নোয়াখালীতে তিনি টানা চার মাস ঘাঁটি গেড়ে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে ঘুরেছিলেন শান্তির বাণী নিয়ে। কাজ করেছিলেন দাঙ্গা ও সংঘাত থামাতে। উপদ্রুত ও বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে তিনি জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। নোয়াখালী থেকে ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধী চলে আসেন তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কলকাতায়। আগস্টের গোড়ায় যখন দেশভাগ আর রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে, গান্ধী তখনও কলকাতায়।

উত্তর কলকাতার উপান্তে সোদপুর আশ্রমে কয়েক দিন থেকে তিনি ১৩ আগস্ট শিয়ালদাহর পাশে বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে ওঠেন। পরিস্থিতির অমানবিকতা, অশান্তি ও হিংসার কারণে ক্ষুব্ধ মহাত্মা গান্ধী ১ সেপ্টেম্বর অনশন শুরু করেন, অনশন ভঙ্গ করেন ৪ তারিখ। ৭ সেপ্টেম্বর তিনি দিল্লি ফিরে যান। এই ছিল তাঁর শেষ বাংলা তথা কলকাতা সফর। কলকাতাতেও বেদনাহত গান্ধী দেখেন তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততায় দ্বিখ-িত হয়ে যাচ্ছে। কলকাতায় সেই ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধী যে হায়দরি মঞ্জিলে অবস্থান করেন, সেই বাড়িটির একটি চমৎকার ইতিহাস আছে।

১৯০০ সালের গোড়ায় ঢাকার নবাব আবদুল গনি বেলেঘাটা অঞ্চলে এই বাগানবাড়িটি কিনেছিলেন। ১৪ কাঠা জমির ৮ কাঠার উপর চার হাজার বর্গফুট জুড়ে বড় ছোট ৭টি ঘর নিয়েই এই ভবন। ১৯৮৪ সালে রাজ্য সরকার হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করে অধিগ্রহণের পর বাড়িটির আমূল সংস্কার করা হয়। ১৯৮৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল উমাশঙ্কর দীক্ষিত ও পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী বাড়িটির নতুন নামকরণ করেন ‘গান্ধী ভবন’।
‘গান্ধী ভবন’-এর সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই একটি হলঘর, তার দেওয়ালে আঁকা আছে গান্ধীকে নিয়ে ফ্রেস্কো। এর ঠিক পিছনে আরও একটি হলঘর, দেওয়ালে অনশনরত গান্ধীর বিশাল ফ্রেমবন্দি ছবি। ডান দিকের কোণের শেষ ঘরটিতেই ‘বাপু’ অনশনে রত ছিলেন। বর্তমানে সম্পূর্ণ কাচ দিয়ে ঢাকা ওই স্থানটিতে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র রক্ষিত আছে। ২০০৭-এ এই বাড়িতেই একটি সংগ্রহালয়ও তৈরি হয়েছে। হয়েছে রাস্তার ওপর একটি স্থায়ী তোরণ।
কলকাতার পাশাপাশি বাংলার আরেক প্রান্তের নোয়াখালীতে গান্ধীর স্মৃতিও কম ঘটনাবহুল নয়। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৪৬, দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালির শ্রীরামপুর। গুহবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে তিনি বিচলিত হলেন, প্রার্থনাসভায় স্বীকার করলেন দাঙ্গার বীভৎসতায় তিনি ক্রুদ্ধ, রাতে ঘুম হচ্ছে না, স্থিতপ্রজ্ঞের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সবার সম অধিকার থাকা উচিত, তবুও মানুষের নিঃসীম শঙ্কা কেন?

প্রতিশোধী বীভৎস দাঙ্গার খবর ও ভারত ভাগ হতে চলেছে জেনে তিনি সংক্ষুব্ধ। তখন একটি কথাই বার বার বলছিলেন তিনি, ‘কেয়া করুঁ?’ তারপরের ঘটনা সবারই জানা। ততদিনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে। গান্ধী জীবনের শেষদৃশ্য তখন চলছে রাজধানী দিল্লিতে।

৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮। সকালে উঠেই গান্ধী সব জরুরি চিঠির উত্তর দেওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করলেন, কেন যেন মনে হচ্ছে যে আগামী কাল আর দেখতে পাবেন না। বিকেল পাঁচটায় তিনি প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার সময় তিনটে বুলেটে বিদ্ধ হলেন, শেষ স্বর শোনা গেল ‘হা রাম’।

তিনি জানতেন যে সত্যকে বোঝা ও বোঝানোর দায় তাঁর, মননচর্চা ও কর্মে নিজস্ব সত্যবোধকে অনুবাদ করার মূল্য তাঁকে দিতেই হবে। তিনি যেন প্রস্তুত ছিলেন সত্যবোধের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করার জন্য। গান্ধীজীবনের শেষ দিনগুলো ছিল মানবতা, শান্তি ও সত্যের অন্বেষণে দীপ্ত। অহিংসার সন্ধানে উদ্বেলিত।

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট