চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শারদীয় দুর্গোৎসব : তত্ত্ব ও মাহাত্ম্য

মনোজ কুমার দেব

৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:১০ পূর্বাহ্ণ

আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের সমাপ্তিতে শুক্লপক্ষে আসে শুভ মহালয়া। এ শুক্লপক্ষ মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষ নামে সমধিক পরিচিত। মহালয়া থেকেই শুরু হয় দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ‘আলয়’ শব্দের অর্থ গৃহ। আমাদের দেহটাই পবিত্র দেবালয়। মহালয়ার এ দিনে পবিত্র এ দেবালয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবীকে অধিষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। জলদগম্ভীর কণ্ঠে শ্রী শ্রী চন্ডী পাঠের মাধ্যমে আবাহণ করা হয় জগৎজননী দুর্গাকে। দেবী মহামায়া আদ্যাশক্তি, পরমবিদ্যা। অনেকগুলো অনুসঙ্গ নিয়ে এ দেবী পূজিতা হন ধরাধামে শ্রীদুর্গা নামে।

প্রথমেই ধর্মীয় অনুসঙ্গ। সনাতন ধর্মের ১৮টি পুরাণের অন্যতম হলো মার্কন্ডেয় পুরাণ। সে পুরাণের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শ্রী শ্রী চন্ডী’। ‘চন্ড’ শব্দ থেকেই ‘চন্ডীর’ উৎপত্তি। প্রকৃতি-প্রত্যয় বিশ্লেষণ করলে পাই চন্ড+ঈপ=চন্ডী। দেশকালের দ্বারা অপরিচ্ছন্ন পরমব্রহ্মই ‘চন্ড’ আর ‘চন্ডী’ হচ্ছে পরমব্রহ্ম মহিষী বা ব্রহ্মশক্তি। জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়া-এ তিন শক্তিতে আবির্ভূতা ত্রিগুণের সমষ্টিভূতা দেবী চন্ডী আবার ‘চন্ডিকা’ নামে প্রসিদ্ধা।

দেবী দুর্গা তথা শ্রী শ্রী চন্ডীর উদ্ভবের কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে দ্বিতীয় মনু স্বারোচিষের অধিকার কাল। ব্রহ্মার পৌত্র হচ্ছে চৈত্র। স্বারোচিষ মন্বন্তরে চৈত্রবংশে জন্ম নেন বিখ্যাত রাজা সুরথ। রাজ্য হারিয়ে ব্যথিত সুরথ একাকী অশ্বারোহণে গভীর অরণ্যে চলে গেলেন। একদা উপস্থিত হলেন বেদজ্ঞ মেধস মুনির শান্ত তপোবনে।

দৈবচক্রে সেখানে উপস্থিত হন এক ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ- সমাধি বৈশ্য। রিক্ত, নিঃস্ব হয়েও নিকটজনের মায়া-মমতা তাঁরা ভুলতে পারছিলেন না। এ সমস্যা থেকে মুক্তি দেখালেন বেদজ্ঞ মহাঋষি মেধস। দুই তাপিত পুরুষের মর্মবেদনা উপলব্ধি করে তিনি জানালেন, শুধু মানুষ নয় ইতর প্রাণীকুলও মায়ামমতায় বশীভুত হয় এক অলৌকিক শক্তির প্রভাবে। এ অলৌকিক শক্তিই হচ্ছে আদ্যাশক্তি মহামায়া। এ দেবীর প্রভাবেই মানুষ পরম সত্যকে বিস্মৃত হয়ে যায় এবং পৃথিবীর মায়াময় ও অনিত্য বস্তুর আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়। ঋষির মুখে একথা শুনে রাজা সুরথ মহামায়ার স্বরূপ জানতে চাইলেন। ঋষি তাঁদেরকে ব্যাখ্যা করলেন দেবী তত্ত্ব আর মহামায়ার এক একটি কাহিনী। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় তিনি জানালেন, মাতৃরূপা দেবীদুর্গার সাধনায় প্রথমে ত্বমগুণ ও পরে রজ:গুণকে আয়ত্ব করতে হয়। রজ:গুণ আয়ত্বের মাধ্যমে ত্বমগুণকে পরাস্ত করতে হয়। মৃন্ময়ী দেবীর কাঠোমোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, স্বাত্তিক গুণাশ্রয়ী দেবীর এক পদতলে সিংহ আর অন্য পদতলে অসুর। উদ্যত সিংহ রজ:গুণ সম্ভুত রাজসিক শক্তি আর উদ্যত অসুর ত্বমগুণের প্রতিভূ। ধর্মীয় তত্ত্বানুসারে দেবী মহামায়া জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়ারূপে তিনটি চরিত্রে প্রকাশমান। এ তিনশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী যথাক্রমে মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতীরূপে পূজিতা হন। মহাকালী হলেন আনন্দরূপা শ্রী শ্রী চন্ডী অনুসারে, সৃষ্টির আদিতে ভগবার বিষ্ণুর নাভিপদ্মে আসীন ব্রহ্মা যখন মধুকৈটভ নামক দুই দৈত্য দ্বারা আক্রান্ত হলেন তাদের বিনাশের জন্য ইচ্ছাশক্তিরূপে মহাকালী আবির্ভূতা হন। তিনিই সৃষ্টির আদিতত্ত্ব, মহামায়ার প্রথম চরিত্র। এরপর আমরা মধ্যম চরিত্রে পাই দেবী মহালক্ষ্মীকে। তিনি হলেন ক্রিয়াশক্তিরূপা। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকে নির্গত বৈষ্ণবী, শৈব, ব্রাহ্মী ও ঐন্দ্রী প্রভৃতি দৈবশক্তির সমন্বয়ে গঠিত মহীয়সী শক্তিই মহালক্ষ্মী। তিনি বৈচিত্র্যময়ী। উত্তর চরিত্রের দেবতা দেবী মহাসরস্বতী জ্ঞানশক্তির প্রতিভূ। অসুর হলো অশুভ আর অজ্ঞানতার প্রতীক। জ্ঞান দ্বারাই অজ্ঞানকে বধ করতে হয়। শুম্ভাদি দৈত্যের বিনাশকামী দেবী জ্ঞানশক্তির প্রকট প্রতিমা হচ্ছে দেবী মহাসরস্বতী। মুনিবর মেধসের পরামর্শে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জগৎপালিনী মহামায়াকে তুষ্ট করে কৃপা লাভ করলেন। বসন্তকালে এ পূজা হয়েছিল বলে কালক্রমে এ পূজা ‘বাসন্তী পূজা’ নামে অভিহিত হয়।

ধর্মীয় অনুষঙ্গের পাশাপাশি প্রাকৃতিক, সামাজিক ও চিরায়ত কিছু অনুসঙ্গ খুবই প্রণিধানযোগ্য। বর্ষাবিধৌত শান্ত প্রকৃতিতে শরৎ আছে জলহারা খন্ড খন্ড মেঘমালার সঞ্চরণে, শুভ্র কাশফুলের আন্দোলন আর শিশির¯œাত শিউলীর আবহ নিয়ে। বর্ষার ¯িœগ্ধ আবাহন শেষ, প্রকৃতিও যেন জগৎজননী মাকে বরণ করতে উম্মুখ হয়ে আছে। পারিবারিক আবহে যদি দেখতে যাই তাহলে দেখা যায়, কৈলাশ পর্বতশৃঙ্গ থেকে মা দুর্গা আসেন এ ধরায় তাঁর পৈত্রিক আলয়ে সন্তানদের নিয়ে বছরান্তে। যে কোন মায়েরই পিত্রালয়ে আসা শাশ্বত পারিবারিক প্রথা হিসেবে স্বীকৃত। আবার প্রত্যেক মা-ই যেন দেবী দুর্গার মত দশভূজা। দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা দশহাতে দশদিক রক্ষা করেন। একইভাবে একজন মাও সন্তানদের রক্ষা করেন দশদিকের অমঙ্গল থেকে।

সনাতন ধর্মমতে, মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির ধারক দেবী দুর্গা নয় দিনের যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত করেন। শুভ দশমী তিথি তাই চিহ্নিত হয় ‘বিজয়া দশমী’ হিসেবে। বিজয়া দশমী আমাদের মনে করিয়ে দেয় সুর আর অসুরের চিরকালীন দ্বন্দ্বের কথা। এ দ্বন্দ্বে সুরের জয় অবশ্যম্ভাবী। সার্বজনীন দুর্গোৎসবে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ সৌভাতৃত্ব আর বিশ্বমৈত্রীর পথকে সুগম করে। এটাই শারদীয় দুর্গোৎসরের মহিমাময় তাৎপর্য।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট