চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : ভাষাসৈনিক কালা চাঁদ বাবু জামাল উদ্দিন

৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

নব্বই বছর বয়সে প্রয়াণ মানে পরিণত বয়সে দেহাবসান। সে অর্থে কালা চাঁদ বাবুর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত নয়। এ-ধরনের জীবন যত ব্যাপক, যত দীর্ঘ হয় ততই মঙ্গল। তাঁদের নির্বাপণে দেশ ও সমাজের ক্ষতি। চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অন্যতম কারিগর কালা চাঁদ বাবু। প্রকৃত নাম শ্রী কৃষ্ণ গোপাল সেন। ৪ অক্টোবর, ২০১৮ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। ৪ অক্টোবর ২০১৯ প্রথম মৃত্যুবাষিকী। তাঁর প্রথম মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষ্যে দেওয়ানজী পুকুর পাড়স্থ পূজা ম-প প্রাঙ্গণে কালা চাঁদ বাবুর স্থায়ী আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. অনুপম সেন সহ বিশিষ্ট জন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে কালা চাঁদ বাবুর আবির্ভাব। পাকিস্তান যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ‘গন্দম’ ভক্ষণ করল, তখন সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সম্প্রীত বিধ্বংসী বিভাজন শুরু হয়। তার প্রতিবাদে মার্কসবাদী তরুণ কালা চাঁন বাবু চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতের ‘কমান্ডার’ হিসেবে আবির্ভূত হলেন।

তাঁর সমকালীন বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের সাথে জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, গণসংগীতের সুরকার অচিন্ত্য চক্রবর্তী, শিল্পী কলিম শরাফী, গোপাল বিশ্বাস, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, সুচরিত চৌধুরী, হরিপ্রসন্ন পাল, ফনী বড়–য়া প্রমুখ। এঁদের ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে প্রগতিশীলতার যে পত্তন হয়েছিল কালা চাঁদ বাবু ছিলেন অন্যতম নির্মাতা। ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রেরণায় দেওয়ানজী পুকুরপারে প্রতিষ্ঠিত হয় অগ্রণী সংঘ। অল্প বয়সে কমিউনিস্ট পার্টিও সাথে যুক্ত হয়ে যান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ার দায়িত্ব পান। নন্দনকাননে গড়ে তোলেন যুব-সংগঠন- শক্তিসংঘ। এ-অঞ্চল ভাগ হওয়ার পর পূর্ববাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়টারই টালমাটাল। সংস্কৃতি ও প্রগতিমনা বহুজন সাম্প্রদায়িক বিভক্তির কারণে চলে গেছেন ভারতে। দেশ ভাগের পর উত্তাল দিনগুলোতে ১৯৫০ সালে সেকালের যুব নেতা মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে হরিখোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ববঙ্গ সাংস্কৃতিক সম্মেলন। কোলকাতা থেকে এসেছিলেন গণসংগীত শিল্পী সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে গণনাট্য সংঘ। অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বাতাবরণ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আহুত এ সম্মেলন বানচালের হুমকি দেয় মুসলীম লীগ। সম্মেলন স্থলের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয় কালা চাঁদ বাবুর ওপর। অগ্রণী সংঘ, শান্তি সংঘ ও চকবাজার নওজোয়ান ক্লাবের সর্বমোট ৬শ সদস্যে স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগ্রেড গঠন করে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে সার্থক করে তোলেন কালা চাঁদ বাবু । মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে নন্দনকাননের সরভুজ মজুমদারের গ্যারেজে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কালা চাঁদ বাবু পালন করেন অনন্য ভূমিকা।

২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার আন্দোলনের পর চট্টগ্রামে যে ১৪ জনকে আটক করেছিলো সরকার, কালা চাঁদ বাবু তাঁদের অন্যতম। দীর্ঘ ১০ মাস কারান্তরালে থাকাবস্থায় একটানা ৪০ দিন অনশন ধর্মঘটের পর তিনি মুক্ত হন। ৬০ এর দশকে প্রলয়ংকারী জলোচ্ছাসের পর আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন কালা চাঁদ বাবু। নিজের তহবিল থেকে ১০০০ টাকা আর্থিক অনুদান দিয়ে আর সংঘের ১০ জন ছাত্রকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কালা চাঁদ বাবু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে ধ্বজনগর যুব শিবিরের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য আওয়মী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী তাঁকে এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য এম কফিলউদ্দিন প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতারাও এখানে থাকতেন। ৭১ সালে ২৫ নভেম্বরে ভারত সরকারের নির্দেশে চার দিনের মধ্যে বাঁশ দিয়ে একশ খড়ের বেডের হাসপাতাল তৈরি করেন কালা চাঁদ বাবু, যা নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার কর্তৃক প্রশংসিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সুজাত আলী উদ্বোধন করেন। শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্যের সুদীর্ঘ জীবনে দেওয়ানজী পুকুরপারে এবং আশেপাশে হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরের এলাকাবাসী সবাই কালা চাঁদ বাবুর আপনজন। ৭২ সাল পর্যন্ত এলাকার পরিবেশটা ছিলো এমন যেনো সবাই একই ঘরের। শহর জীবনের কোলাহল ছিল এখানে অনুপস্থিত। শান্তি-সম্প্রীতি সৌহার্দ্যের মেলবন্ধন সর্বত্রই। স্বাধীনতাত্তোর কালে এলাকার যুবশক্তি গঠনের অভিপ্রায়ে পুনরায় উজ্জীবিত করেন অগ্রণী সংঘকে। গড়ে তোলেন পাঠাগার, প্রতিষ্ঠা করেন অগ্রণী সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র। জনস্বার্থে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানজী পুকুরের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। কালা চাঁদ বাবু বিশিষ্টজনদের সাথে নিয়ে এলাকার ঐতিহ্য রক্ষায় প্রায় সাড়ে সাত গ-া জমিতে স্থায়ী সার্বজনীন পূজাম-প গড়ে তুলেন। গঠন করে ট্রাস্টি বোর্ড।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত এলাকার শহীদদের স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্যে শহীদ মিনার গড়ে তোলেন। তাই তিনি আমাদের নমস্য-শ্রদ্ধায়। শ্রী কৃষ্ণ গোপাল সেন (কালাচাঁদ)-র জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান থানাধীন কোয়েপাড়া গ্রামে ১৯২৯ সালের ২৪ নভেম্বর। পিতা স্বর্গীয় যোগেশ চন্দ্র সেন, মাতা স্বর্গীয়া সুহাসিনী সেন।

লেখক : গবেষক ও প্রকাশক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট