চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

১৯৭১-এর নৃশংসতা এবং বিজয় মাসের কথা

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ | ৯:১০ অপরাহ্ণ

ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ডিসেম্বর মাস বাঙালির বিজয়ের মাস। সারা দেশে চলছে বিজয়মেলা। এই বিজয়মেলা পাকিস্তানী দোসরদের পছন্দের নয়। কারণ এই মাসব্যাপী তাদের অত্যাচারের কাহিনী স্মৃতিচারণ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং লেখালেখির মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। তাদের গণহত্যা মানুষের জানা হয়। এইসব নির্যাতনের একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা গ্রন্থিত আকারে আমরা পাঠ করার সুযোগ পাই রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ থেকে। পাঠ করে আমরা জানতে পারি, আমরা অনুভব করি ধর্মের নামে রাষ্ট্রের নামে কি ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার আমরা হয়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে। তার সাথে পৃথিবীর আর কোনো হত্যাকান্ডের তুলনা হয় না।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আস্ফালন আশংকাজনকভাবে বেড়ে যায় ২০০১-এর জোট সরকারের আমলে। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এরা এখনো সক্রিয় এবং স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে বক্তব্য দেয়া শুরু করে। নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে। ‘১৯৭১:ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’-র উপর ভিত্তি করে ছোট ছোট ডক্যুমেন্টারী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দেশের আনাচে কানাচে দেখানোর ব্যবস্থা করা তাই এখন আবশ্যক। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের উপর বিভিন্ন তথ্য সমৃদ্ধ লিফলেট প্রকাশ করে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন।
মৃত্যুদন্ড : স্মৃতি একাত্তর….
‘বয়স তখন খুবই কম। অধ্যয়ন করছি নবম শ্রেণীতে। একসময় দেশময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃত্ব স্থাপন করে। তখন ইয়াহিয়ার আদেশে স্কুল-কলেজের তালা খোলা হয়। সম্ভবত দিনটি ছিল ১৩মে। একটি বিশেষ সংবাদ সংগ্রহ করব আমি। যাচ্ছি শ্রীমঙ্গল ব্রাহ্মণবাজার সড়ক ধরে। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটার ঘরে। আমি যে বিদ্যালয়ের ছাত্র সে বিদ্যালয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে-‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’। শুনে শরীর যেন জ্বলে ওঠে। পায়ের গতিও একটু বেড়ে যায়। এবারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে – প্রধান শিক্ষক ফ্ল্যাগষ্ট্যান্ডেরর নীচে দাঁড়িয়ে রশি টানছেন আর চাঁদতারা মার্কা পাকিস্তানী পতাকা সাপের মত উপরে উঠছে। মুহূর্তেই একটি ঘৃণাবোধ জন্মে সারা দেহ মন জুড়ে। একটিবারও স্মরণ হয়নি যে ঐ বিদ্যালয়ে আমি তখন অবাঞ্ছিত ঘোষিত। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। এ পতাকা, এ সঙ্গীত আমার মাতৃভূমিতে চলতে পারে না। বাংলার সন্তান হিসাবে আমি তা চলতে দিতে পারি না, চলতে দেব না। এবারে প্রায় দৌড়ে অগ্রসর হচ্ছি। হিতাহিত জ্ঞান যেন লোপ পেয়েছে। বিদ্যালয়ের সামনে যখন পৌঁছি তখন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শেষ। উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাশ রুমে ঢুকছে। কিন্তু আমার ভ্রুক্ষেপ নেই কোন দিকে। একটানে নামিয়ে ফেলি পতাকা। পায়ের নীচে রেখে ছিন্ন ভিন্ন করে দেই বস্ত্রখ-কে। দিয়াশলাই না পাওয়াতে আগুন ধরাতে পারিনি। রাগে ক্ষোভে আমি তখন ফোঁস ফোঁস করছি। খেয়াল করিনি যে আমি তখন দালালদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছি। পালাবার পথ আমার রুদ্ধ। প্রধান শিক্ষক ধরে নিয়ে গেলেন তার কক্ষে। ইতোমধ্যে শান্তি কমিটির আহ্বায়ক এসেছেন। তারই এক মেয়ে নাকি এ সংবাদটা ত্বরিত প্রচার করেছিল।
শুরু হল বিচার। পাকিস্তানের সংহতি বিরোধী কাজ, জাতীয় পতাকার অবমাননা, নাশকতামূলক কার্য ইত্যাদি অভিযোগ। আমার শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক বুঝাচ্ছিলেন কি হতে যাচ্ছে বা কি হতে পারে। তাই মূল বিচারকের ভূমিকায় তিনি অভিনয় শুরু করলেন। সময় খুবই কম। পাক হায়েনারা আসার আগেই যা করার করতে হবে। কয়েক মিনিটের বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিলেন আমার অপরাধসমূহ, এমন অপরাধ পাকিস্তান দন্ডবিধি এবং দেশরক্ষা আইনের কোন্ কোন্ ধারায় পড়ে, লংঘনকারীদের শান্তি কি ইত্যাদি। তারপর তিনি রায় ঘোষণা করলেন মৃত্যুদ-। আমার আবেগ ততক্ষণে কেটে গেছে। আমি তখন পুরো স্বাভাবিক। বুঝলাম দেশের স্বাধীনতার শহীদদের সাথে আমার নামও যুক্ত হবে। প্রধান শিক্ষকের বক্তৃতা তখনও চলছে। চারটার পর মৃত্যুদ- কার্যকর হবে। কারণ, ‘এ কুলাঙ্গারটা আমার স্কুলের ছাত্র ছিল। তাই স্কুলের মান সম্মানও জড়িত। অতএব স্কুল আওয়ার-এর পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে এবং এ সময়টা স্কুলেই বিশেষ ব্যবস্থাধীনে থাকবে।
শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মেনে নিলেনযুক্তিটা। আর বিশেষ ব্যবস্থাধীন অবস্থায় আটকাবস্থা থেকে মুক্তির বিশেষ একটা সুযোগও করে দিলেন প্রধান শিক্ষক। পালিয়ে প্রাণরক্ষা করলাম সেদিন। অবিশ্যি তার ১০০ভাগ কৃতিত্বই আমার শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষকের। স্বাধীনতার এত বছর পর ঘটনাটি লিখতে বসে বার বার কলম আটকে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে স্মরণ হচ্ছে ঐ দালাল ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কুৎসিত চেহারা।’ একাত্তরে স্কুল ছাত্র বর্তমানে সিলেটের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী তাজুল আহমেদ যুদ্ধে কিভাবে সংগ্রাম ও জীবন রক্ষা করেছেন এই বর্ণনা থেকে – তা জানতে পারি আমরা।
নৃশংসতা ………
স্ট্যাটিসটিকস বিভাগের প্রধান মুনিরুজ্জামান, তাঁর ভাই আর দু’ভাইয়ের দু’ছেলে – চারজনকে ঘর থেকে বের করে এন মেসিনগানের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। সোলজাররা খুন করে বেরিয়ে যেতেই অধ্যাপকের স্ত্রী দরজা খুলে ছুটে গেলেন। ছেলে, স্বামী, দেওর, রক্ত, গুলি বিঁধে যাওয়ার যন্ত্রণা – তার ভেতর থেকে টানতে টানতে স্বামীকে ঘরে নিয়ে এলেন। তখনো প্রাণ ছিল। তিনি স্বামীকে শোবার ঘরের পালঙ্কের নীচে ঠেলে দিলেন। তিনঘন্টা পরে ভোররাতে সৈন্যরা ফিরে এল। হিসেব মেলে না। ওরা আবার জোর করে ঘরে ঢুকলো। অর্ধমৃত অধ্যাপককে পা ধরে টানতে টানতে আবার করিডোরে নিয়ে এল। খানিক আগে গুলিলাগা দেহটা দরজায়, সিঁড়ির মোড়ে আটকে যাচ্ছিল – থেতলে যাচ্ছিল। একজন ক্যাপ্টেন কোমর থেকে পিস্তল বের করে নিয়ে একবার অধ্যাপকের দিকে তাকালো। আরেকটি বুলেট খরচ হয়ে গেল।
মোরগ ডাকা ভোর এলেও হত্যা থামলো না।
দিনের আলোয় পুরনো ঢাকায় সৈন্যরা একটা মজার খেলা খেলছিল। এক এক এলাকা জুড়ে ওরা রকেট ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তাপে ভাপে পাগল পারা মানুষজন যেই বেরিয়ে আসছিল অমনি সৈন্যরা ঢালাও চাঁদমারি খেলছিল। শুক্রবার সকাল থেকেই এই খেলার শুরু। শাঁখারি বাজারে সরু রাস্তার দু’মোড়েই মেসিনগান বসানো হয়। রমনা কালীবাড়ীতে, নয়াবাজারে, রায়েরবাজারে – একই ফুর্তি। শুক্রবারেও তাও আবার ধর্মের নামে।
পীর বাড়িতে গণহত্যা……
‘আমি আবদুল হান্নান। ছোটকাল থেকেই আমি পীর বাড়িতে মানুষ। তখন আমার বয়স ১৪ এবং ৭ম শ্রেণীতে পড়ি। সেদিন আমি সেহরী খেয়ে উঠতেই জানতে পারি পাক মিলিটারি আসার কথা। ওজু করে ফজরের নামাজ শেষে সবাই মিলিতভাবে (স্ত্রী ও পুরুষ) তওবার নামাজ শেষ করেন। ততক্ষণে বাড়ীর প্রায় সবাইকে ধরে অন্য ঘরের বারান্দায় পেছনে হাত বেঁধে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন সৈন্য এসে দুলাভাইকে ধরে নিয়ে যায় এবং সবার সাথে বেঁধে রাখে। তখন পাশ্ববর্তী ধাওয়াকোলা গ্রামের আবু সাঈদ নামে আমার সহপাঠী একজন রাজাকারের সাথে আমি কথা বলি। তখন একজন পাক-পশু এসে ছোট্ট একটা অস্ত্র আমার বুকের উপর ধরে জিজ্ঞেস করে,‘জিন্না মান্না কাঁহা হ্যায়’। আমি চিনি না বলে জানাই। তখন রাজাকার সাঈদ আমার পরিচয় দেয় এভাবে ‘বোহিনকে বাড়ী থাকে’। সে কথা শুনে ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আমি দেখলাম সবাইকে বারান্দা থেকে উঠিয়ে বাইরে আনা হচ্ছে। আমি প্রায় পিছু পিছু বাইরে চলে আসি। দুলাভাই তখন আমাকে বাড়িতে গিয়ে বুবুর কাছ থেকে মাফ নিয়ে আসতে বলে। কথা বলতে দেখে একজন সৈন্য ছুটে এলে দুলাভাই বলে যে, ঘর খুলে গরু বার করতে বলছি। সেই কথা শুনে দৌড়ে বাড়ি থেকে চাবি নিয়ে গোয়াল ঘর খুলে একটা গরু বার করার ছল করে দেখতে থাকি। ওরা সবাইকে নিয়ে পূব দিকে মুখ করে পুকুরের পাড়ে বসিয়ে রাখে। তারপর পেছন থেকে প্রথমে মেজো ভাইকে গুলি করে।
গুলির শব্দে হাত থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত গরুও দৌড়ে পালায়। আর আমিও সেখানে থাকতে পারিনি। গরুর পেছনে পেছনে আমি দৌড়ে পালাতে থাকি। তখন ক্যাট ক্যাট করে একনাগাড়ে গুলি হতে থাকে। কিছুদূর ছোটার পর মোজাম পাগলা নামে একজন লোক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের পালাতে নিষেধ করে বলে: তোরা ফিরে আয়। দেখ, সব শেষ হয়্যা গেছে। ফিরে এস দেখলাম ১১টি লাশ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কারো মাথা চুরমার, ঘিলু বের হয়ে ছিটকে পড়ে গেছে। কারো বুক ঝাঁঝরা, কারো দাঁত-মুখ বিকৃত, কারো গলা ও গাল থেকে খাবলা হয়ে মাংস উড়ে গেছে।’
‘আমার স্মৃতিতে যখন সেই ভয়াবহ দৃশ্য ভেসে ওঠে তখন আমি অস্থির হয়ে প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওই নরপশু ও তাদের দোসরদের প্রতি ঘৃণা নিক্ষেপ করি।’ বগুড়ার রামশহর গ্রামের বিখ্যাত পীর বাড়ীতে একাত্তর সালে পবিত্র রমজান মাসে হত্যাকান্ড সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন পীর বাড়ীর বেঁচে যাওয়া সদস্য আবদুল হান্নান।
পুনশ্চ : সময়ের ডাক………
এখন আমরা আবার সকলকে এক হয়ে এককাতারে দাঁয়ে একাত্তরের মতো কাজ করতে হবে। একাত্তরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা সবাই বাঙালি। বাংলা আমার। আমরা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বাঙালি এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী যারা একাত্তরে গণহত্যার সাথে জড়িত তারা অপেক্ষায় আছে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির বিজয় ছাড়া এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেশের সমৃদ্ধি সম্ভব নয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট