চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কিশোর গ্যাং, কিশোর অপরাধ ও আমাদের দায়িত্বশীলতা

ড. মোহাম্মদ নুর হোসাইন

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক বহুবিধ সমস্যার মাঝে বর্তমানে আলোচিত একটি সমস্যা “কিশোর গ্যাং” বা “কিশোর গ্রুপ”। ঢাকাসহ দেশের শহর-গ্রামে বিভিন্ন নামে এখন কিশোর গ্যাং বা কিশোর চক্র গড়ে উঠেছে। সাধারণত পনেরো বছর থেকে বিশ বছরের বয়সের কিশোররা প্রথমে সময় কাটানো বা আড্ডা দেয়া অথবা মোটর রেস ইত্যাদির মাধ্যমে আনন্দ করার উদ্দেশ্যে এ গ্যাং সৃষ্টি করে। এরপর আত্মরক্ষা, শক্তি অর্জন, অন্য গ্যাং এর সফল মোকাবেলা, তাদের ওপর বিজয় লাভ ইত্যাদি মানসিকতা থেকে তারা বিভিন্ন অপরিণামদর্শী ও অনর্থক কাজে জড়িত হতে থাকে। আড্ডার মধ্যে মাদক সেবন, ইভটিজিং, পরস্পরের মধ্যে শক্তি প্রদর্শন ইত্যাদির ঘটনা ঘটে। নিজ এলাকায় আমি অপ্রতিদ্বন্ধী, অপারাজেয়, বীর-বাহাদুর ইত্যাদি মানসিকতাও তাদের মনে কাজ করে। সিনিয়র-জুনিয়রের দ্বন্দ্ব, অন্যজন বা এলাকার ওপর নিজের বা নিজ এলাকার আধিপত্য বিস্তার, কারো মন্দ আচরণের প্রতিশোধ গ্রহণ ইত্যাদি থেকে তারা শক্তি যোগাড় করতে গিয়ে অস্ত্র ক্রয়, সংগ্রহ, ব্যবহার করতে শুরু করে। মাদক সেবন করতে গিয়ে মাদকের ব্যবসায়ও শুরু করে। ধীরে ধীরে ছিনতাই, ধর্ষণ, খুন-খারাবির সাথেও তারা জড়িয়ে পড়ে। গত ৬ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরার নাইনস্টার গ্রুপের সদস্য কিশোর আদনান একই এলাকার ডিসকো গ্রুপের হাতে খুন হয়। এরপর কিশোর গ্যাং এর ব্যাপারে সবার টনক নড়ে। চট্টগ্রামের জামাল খান এলাকাতেও ঘটেছে কিশোর গ্যাং এর হত্যাকা-। বরিশালে খুন হয়েছে কিশোর হৃদয়। ফরিদপুরের ১৭ বছরের কিশোর নতুন মোটর সাইকেলের দাবিতে তার মা-বাবার গায়ে আগুন দেয়। মা বেঁচে গেলেও বাবা মারা যায়। এভাবে কিশোর গ্যাং এখন পুরো সমাজের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। দিন দিন গ্রুপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অভিভাবকসহ সর্বশ্রেণির মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দঁড়িয়েছে এমন গ্যাং। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক অন্ধকার যেন আচ্ছাদিত করছে। ব্যাকুল হয়ে পড়ছে মা-বাবারা। সচেতন মহল মনে করছেন, যেভাবেই হোক না কেন, এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে খুব দ্রুত। অন্যথায় আগামীর স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
গুণীজনরা কিশোর গ্যাং সৃষ্টি এবং এর প্রতি তাদের আকর্ষণ ও সম্পৃক্ততার অনেক কারণ বর্ণনা করেছেন, যার সারসংক্ষেপ হলো, ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা, অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতা, আধুনিক প্রযুক্তির অবাধ ও অপব্যবহার, অসময়ে অর্থের সহজলভ্যতা, পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়, সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতিচর্চার অভাব, পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা, পারিবারিক অনুশাসনের অভাব, অপরাধীর অবাধ বিচরণ, অপরাধী সহজে ছাড়া পাওয়া, টাকা আর ক্ষমতা থাকলে সবকিছুই সম্ভব- এমন সমাজ ব্যবস্থা।

যে কারণেই এমন গ্যাং সৃষ্টি হোক না কেন, দেশ, জাতি, সমাজের জন্য এটি একটি বড় অশনি সংকেত। যারা আগামীর দেশ গড়ার কারিগর, উন্নতির সোপান, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মূল কেন্দ্রবিন্দু তাদের এমন পথ চলা, এমন আচরণ ও কর্মকা- জাতিকে হতাশায় ভুগাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সর্বমহলকে গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, সমাজপতি সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের এগিয়ে আসতে হবে দায়িত্ব নিয়ে। শুধু মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্বের ওয়াজ করে শ্রোতাদেরকে কাঁদালে চলবে না, সন্তানের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব কী- তাও বুঝাতে হবে ভালভাবে। বেতনের জন্য শিক্ষকতা নয়, মানুষ গড়ার দায়িত্ব নিয়ে এ পেশায় এসেছি- এমন মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করতে হবে সম্মানিত শিক্ষাগুরুদেরকে। সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হবে সমাজপতিদেরকে। এ সমস্যা উত্তোরণের জন্য পারিবারিক শাসনের বিকল্প নেই। মা-বাবাকে সময় দিতে হবে ছেলে-মেয়েদেরকে। বিদ্যালয় বা লেখা-পড়ার সময়ের বাইরে ছেলে-মেয়েরা কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে কোথায় আড্ডা দেয়, তার খবরাখবর রাখতে হবে অভিভাবকদেরকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেলে কী করে, কী দেখে, কার সাথে কথা বলে সেগুলোরও খবর রাখা দরকার। অসময়ে উন্নত যোগাযোগ মাধ্যম হাতে তুলে দেয়া এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দেয়া বন্ধ করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ছোট বেলা থেকেই। মসজিদ-মন্দিরে সময় দেয়া যেমন ইবাদত বা পূণ্য পাওয়ার মাধ্যম তেমনি সন্তান-সন্ততিকে মানুষ করাও ইবাদত মনে করতে হবে। সংসার গড়লে হবে না, এর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে পরিপূর্ণভাবে। কারণ, ছেলে-মেয়েদের জীবন অভিভাবকদের নিকট আমানত। তারা যেমন নিয়ামত তেমনি পরীক্ষারও মাধ্যম। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা ছাড়া কিছু নয়” (সুরা তাগাবুন: ১৫ )। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর” (সুরা তাহরিম: ৬)।

কোন সন্তান মন্দ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। মা-বাবার জীবনাচারের প্রভাবে সন্তান-সন্ততির প্রভাবিত হয়। তাই সর্বাগ্রে তাদেরকে নৈতিকতার চর্চা, ধর্মীয় অনুশাসন মানা, সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে। বড়জনকে শ্রদ্ধা করা, গুরুজনে ভক্তি প্রদর্শন, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ইত্যাদি সৎচরিত্র শিখবে স্বীয় মা-বাবা থেকে। অভিভাবক যেমন, সন্তান-সন্ততি তেমন হবে- এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। ধার্মিক হওয়া না হওয়া, নৈতিকতা সম্পন্ন হওয়া না হওয়া নির্ভর করে অনেকটা মা-বাবার ওপর। তাই রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু স্বভাবধর্ম নিয়ে জন্মায়। কিন্তু তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা অগ্নিউপাসক বানায়” (বুখারি-মুসলিম)। কাটা গাছে যেমন মিষ্টি ফল আশা করা যায় না, তেমনি সন্ত্রাসী, অবৈধ উপার্জনকারী, অর্থলিপ্সু, ঘুষখোর, পরের হক ধংসকারী, দুর্নীতিবাজ, বেয়াদব, অহংকারী, লোভী, অসহিষ্ণু পিতা-মাতা থেকে সুসন্তান আশা করা যায় না। মা-বাবার মাঝে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, সম্পর্কহীনতাও ছেলে-মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে সময় কাটাতে বাধ্য করে। আর বাইরে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে নানান অপকর্মে। তাই মা-বাবার সংযত জীবন যাপন, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসাও সন্তানদের ঘরমুখী করে রাখতে পারে।

মা-বাবার পাশাপাশি শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজেরও দায়িত্ব আছে ছেলে-মেয়েদের সুপথে পরিচালনার জন্য। ক্ষমতাবান, প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্র ও সরকারেরও মূল দায়িত্ব আগামীর যোগ্য নাগরিক তৈরি করা। তাদেরকে সুপথে পরিচালিত করা। সমাজের কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারে না পবিত্র হাদিস মতে। যেমন, বলা হয়েছে, “সাবধান, তোমরা সবাই রাজা। আর তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে তোমাদের প্রত্যেককে জবাবাদিহি করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাদের ব্যাপারে দায়িত্ববান; তাকে প্রজাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষব্যক্তি তার পরিবারের প্রধান। তাকে তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তাঁর স্বামীর ঘর ও সন্তান-সন্ততির ব্যাপারে দায়িত্বশীল; তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তাদের ব্যাপারে। দাস তার মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে সে সম্পর্কে। সাবধান, তোমরা সবাই নেতা; তোমাদেরকে তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে (বুখারি-মুসলিম)।

মূলত কিশোর বয়সে আবেগ, উন্মাদনা, উত্তেজনা, হিরোইজম, ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শনী মনোভাব থাকে। এটাকে সুপথে পরিচালিত করতে হবে। তারা শুধু পুুঁথিগত বিদ্যা বা পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। তাই পারিবারিক পাঠাগার, সামাজিক পাঠাগার তৈরি করে তাদেরকে মহামনীষীদের জীবনীসহ মানসিক তৃপ্তিদায়ক গ্রন্থ পাঠের দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। খেলাধুলা, সুস্থ্য সংস্কৃতিচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। কল্যাণকর সামাজিক কাজেও সম্পৃক্ত করতে হবে কিশোর ও যুবক-যুবতীদেরকে। উদ্বুদ্ধ করতে হবে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের প্রতি। ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত কোন কিশোর এ জাতীয় গ্যাং করার সময় পাবে না এবং সে দিকে আকৃষ্টও হবে না। ইসলামি শরিয়ার একটি কর্মসূচি তথা পাঁচ ওয়াক্ত নামায শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীদেরকে এ জাতীয় কর্মকা- থেকে বিরত রাখতে যথেষ্ট। তাই পবিত্র হাদিসে সাত বছর বয়স থেকে নামাযের আদেশ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সাত থেকে দশ বছর পর্যন্ত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নামাযে অভ্যস্ত করতে না পারলে দশ বছর বয়সে তাকে মৃদু প্রহারের কথাও বলা হয়েছে। এরপরও না হলে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৯৫)। হযরত লোকমান (আ.) স্বীয় সন্তানকে যে সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন তাতে শিশু-কিশোরদের মুক্তির বার্তা রয়েছে। বয়সের উন্মাদনা, শক্তি প্রদর্শনের মানসিকতা, অহংকার-অহমিকা, আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদি দুশ্চরিত্রের অবসান আছে তাঁর সে উপদেশের মধ্যে। বলা হয়েছে, “হে আমার সন্তান, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয় শিরিক সবচেয়ে বড় পাপ ——- হে আমার সন্তান, সরিষার দানা পরিমাণ কোনোকিছুও যদি পাথরের ভেতরে, জমিনের নিচে বা নভোম-লের কোথাও (লুকিয়ে) থাকে, তবে আল্লাহ তা-ও হাজির করবেন। আল্লাহ তো সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত। হে আমার সন্তান, নামায কায়েম করো। অন্যকে সৎকর্মে অনুপ্রাণিত করো এবং অসৎকর্মে নিরুৎসাহিত করো। আর বিপদে ধৈর্য্যধারণ করো। এটাই প্রত্যয়ী মানুষের কাজ। কখনো অহংকারবশত মানুষকে অবজ্ঞা করো না, মাটিতে গর্বিতভাবে পা ফেলো না। উদ্ধত অংকারীকে নিশ্চয় আল্লাহ অপছন্দ করেন। চালচলনে সুশীল হও। মোলায়েম কন্ঠে কথা বলো। (কখনো কন্ঠস্বরকে গাধার স্বরের মতো কর্কশ করো না) নিশ্চয় গাধার স্বর সবচেয়ে কর্কশ (সুরা লোকমান: ১৩, ১৬,১৭, ১৮, ১৯)।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খতিব, চবক আ/এ জামে মসজিদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট