চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাধনা, বিশালত্বে আটরশি পীর ও তাঁর দরবার

কালান্তরে দৃষ্টিপাত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

ফরিদপুর আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের বিশালত্ব ভাববার বিষয়। সমগ্র বাংলাদেশে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের তুলনা হয় এ রকম অন্য কোন ধর্মীয় কমপ্লেক্স অন্য কোথাও দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে উক্ত জাকের মঞ্জিলে যেমনি কোটির অধিক ভক্ত মুরীদ রয়েছে, তেমনি সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। এমনিতে আমাদের দেশে ধর্মীয় কর্মকান্ড নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি বেশি। ধর্মীয় কর্মকান্ডের মধ্যে পীরি-মুরীদি নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি আরও বেশি। তেমনিভাবে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল বিশালত্ব লাভ করায় উক্ত তরিক্বত জংশন নিয়ে অপরাপর অনেকের হিংসা-বিদ্বেষ থাকাটা স্বাভাবিক। তথায় গমন করে মরহুম হযরত পীর সাহেব কেবলার জীবনীগ্রন্থের সন্ধান করি। এতে তথাকার দায়িত্বরত লাইব্রেরিয়ান থেকে জানতে পারি মরহুম পীর সাহেব কেবলা জীবদ্দশায় তাঁরই আত্মজীবনী তিনি রচনাও প্রকাশ করে গেছেন।

মরহুম পীর সাহেব (রহ.)’র আত্মজীবনী পড়ে হতচকিত হই। তিনি তাঁরই পীর সাহেব কেবলার দরবারে কঠোর রেয়াজত তথা সাধনার নির্দয় ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তা উপলদ্ধি করে অবাক হয়ে যাই। আমার ধারণা ছিল সমগ্র বাংলায় পান্ডুয়ায় হযরত শেখ আলাওল (রহ.) তাঁর সুযোগ্য পুত্রকে নবাবী/জমিদারী থেকে সরিয়ে তরিক্বতের রেয়াজতে তথা কঠোর সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়ে দেন। এবং তিনিই অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন কঠোর রেয়াজতের অধিকারী হিসেবে। কিন্তু বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের মরহুম পীর সাহবের আত্মজীবনী পাট করে বাংলার এতদাঞ্চলে আরও একজন কঠোর রেয়াজতের অধিকারী রয়েছেন তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের মরহুম পীর সাহেবের নাম হযরত শাহ হাশমত উল্লাহ (রহ.)। তিনি শেরপুর জেলার অধিবাসী ছিলেন। শিশু বয়সে মাতৃহারা হন। পারিবারিক পরিমন্ডলে আরবি, ফার্সি শিক্ষা লাভ করেন। হযরত খাজা ইউনুচ আলী এনায়েতপুরী (রহ.) শেরপুরে তশরীফ আনলে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের মরহুম পীর সাহেব হযরত ফরিদপুরী শৈশবকালে তথা মাত্র ৮/১০ বছর বয়সে তারই নেক নজরে পড়েন। হযরত এনায়েতপুরী (রহ.) এর আহ্বানে হযরত ফরিদপুরী (রহ.) ও তাঁর অপর ভাইকে তাদেরই পিতা পীরের দরবারে সোপর্দ করেন। তিনি শৈশব কাল থেকে দীর্ঘ ৪০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে তারই পীরের কাছে আত্মনিয়োজিত ছিলেন। স্বীয় পীরের চরণে অনাহার-অনিদ্রাসহ অমানুষিক শ্রম ও অপরিসীম ত্যাগের মুখোমুখি হন। তাঁকে স্বল্প পরিমাণ খাবার দেয়া হত। অধিকাংশ সময় দৈনিক ১ বার কিংবা ২ বার খাবার দিতেন। অন্য সকলে দু’বেলা পেট ভরে খাবার পেতেন। কিন্তু পরিশ্রমের দিক থেকে তাঁর বিপরীত। তাঁকে ক্ষুধার্ত দুর্বল শরীরে মাটিকাটাসহ ৯/১০ কিলোমিটার দূর থেকে বোঝা বহন করে আনতে হত। নিকটস্থ যমুনা নদীর ঘাট থেকে গরুর গাড়ি বোঝাই করে ধান-চাল-ডাল ইত্যাদি মালামাল নিয়মিত আনতে হত।
হযরত ফরিদপুরী (রহ.) তারই পীর হযরত এনায়েতপুরী (রহ.)’র নিদের্শে তাঁর পৈতিৃক বাড়ী ভিটা জমিজমা বিক্রি করে দিয়ে সমুদয় টাকা-পয়সা পীরের দরবারে সোপর্দ করে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যান।

পীরের দরবারে মাহফিলের খেদমত করতে গিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে বোঝা বহন করে মাহফিলের যাবতীয় সরঞ্জাম আনতে হত তাকে। তিনি প্রথমদিকে এক রকম কঠোর সাধনা সহ্য করতে না পেরে বারেবারে বাড়ী ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হয়নি। মোরাক্বাবা তথা ধ্যানে বসলে একাধারে ৫/৭ ঘন্টা বা আরও অধিক সময় নিমগ্ন থাকতেন।
অনাহারে অর্ধাহারে একদম ক্ষীণদেহ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও তাঁর কঠোর পরিশ্রমের সাধনা থেকে বিচ্যুত হননি।
কঠোর ধ্যান ও সাধনায় অতিবাহিত করার পর তাঁরই পীরের নিদের্শে কলকাতা যেতে বাধ্য হন জীবন-জীবিকার সন্ধানে। প্রথম প্রথম কলকাতা না যেতে নিজের পীর সাহেবের প্রতি আকুতি প্রকাশ করেন। যেহেতু তাঁর শরীর ছিল খুবই দুর্বল। টাকা-পয়সা নেই, কোথায় কার কাছে যাবে, কিভাবে থাকবে, কে চাকুরি দেবে এ সকল চিন্তা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতা তাঁকে যেতেই হল। তথায় গিয়ে ফরিদপুর আটরশী নিবাসী মোহসিন খান সাহেবের সাথে পরিচয় পরবর্তী ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। এতে মোহসিন খান তাঁর সাথে এনায়েতপুরস্থ পীরের দরবারে এসে মুরীদ হয়ে যান।
অতঃপর হযরত ফরিদপুরীর ভাতিজিকে মোহসীন খান বিয়ে করেন। অপরদিকে মোহসিন খানের ভাতিজীর সাথে হযরত ফরিদপুরী পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

১৩৫৪ বাংলা সনে হযরত ফরিদপুরী কলকাতা থেকে ফরিদপুরের আটরশি চলে আসেন। আটরশিতে মোহসীন খানের গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন। ঘরটি ছিল খুবই ক্ষুদ্র ছনের ছাউনিযুক্ত। তথা হতে তিনি তাবলিগে তরিক্বতের কাজ শুরু করেন।

ফরিদপুরের উক্ত এলাকায় কিছু কিছু গ্রাম নামকরণ হল আট রশি, সাড়ে সাত রশি, চৌদ্ধ রশি, আড়াই রশি ইত্যাদি।
ফরিদপুরের এই আট রশি গ্রামেই তিনি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম প্রথম তাঁর মুরীদরা মাহফিলের দিন মুষ্টি চাউল নিয়ে আসতেন। এক বছরের ব্যবধানে তিনি মাত্র ৮ টাকা দিয়ে একটি জীর্ণ কুঁড়েঘর খরিদ করেন। পরবর্তীতে এ কুঁেড় ঘরের নামকরণ করেন জাকের ক্যাম্প তথা জিকিরকারীগণের ক্যাম্প। যা পরবর্তীতে আজকের এ বিশাল বিশ্ব জাকের মঞ্জিল।
হযরত ফরিদপুরী তাঁর আত্মজীবনীতে আরও উল্লেখ করে গেছেন, তিনি যেদিন আটরশিতে আগমন করেন সেদিন ছিল পবিত্র ঈদুল আযহা তথা কোরবানী ঈদের দিন। উক্ত দিবসেই তথাকার স্থানীয় লোকজন লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল। তথায় কোন নামাজ ছিল না,সমাজ ছিল না, ধনী-মানী-জ্ঞানী-গুণী লোক বলতে ছিল না। গরু কোরবানী হত না,গরুর গোস্তকে মুসলমানরাও অখাদ্য মনে করত। মুসলমানীত্ব কি তা জানত না। ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ অস্পষ্ট ছিল।তিনি আটরশি পৌঁছে মোহসীন খান ও অপর ২ ব্যক্তিকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়লেন। ধীরে ধীরে আলোচ্য জাকের ক্যাম্পের জাকেরানের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং সুনামও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল তাঁর উক্ত জাকের ক্যাম্পের বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে দয়ে। তাঁর এ জাকের ক্যাম্পের বিরোধিতা করার জন্য অন্যান্য এলাকা থেকে আলেম-পীর, সাধারণ শিক্ষিত লোকজন, একত্রিত হয়ে জাকের ক্যাম্প প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। বহু সভা সমাবেশের আয়োজন করে অসংখ্য প্রচার পত্র বিলিবণ্টন করে। কিন্তু তাদের এই বিরুদ্ধাচারণ সমূলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাঁর প্রথম দাম্পত্য জীবন সুখকর হয়নি। তাঁর আত্মজীবনীতে আরও উল্লেখ করেন। তাঁরই পিতার ইচ্ছায় মাত্র ১৬/১৭ বছর বয়সে শেরপুরস্থ এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু হযরত ফরিদপুরী এনায়েতপুরস্থ স্বীয় পীরের দরবারে জীবন উৎসর্গ করে শেরপুরস্থ পৈতিৃক বাড়ি ভিটা স্বত্ব বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় তাঁর প্রথম দাম্পত্য জীবনে চিড় ধরেছিল।যেহেতু একদিকে দরিদ্রতা অন্যদিকে আটরশিতে মোহসীন খানের ভাতিজীকে দ্বিতীয় বিয়ে করায় উক্ত প্রথম স্ত্রী সংসার ত্যাগ করে পিত্রালয়ে চলে যান।হযরত ফরিদপুরী শ^শুরালয়ে গিয়ে উক্ত চলে যাওয়া প্রথম স্ত্রীকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁর প্রথম স্ত্রী একেত স্বামীর নিঃস্ব অবস্থা, দ্বিতীয়ত স্বামীর দ্বিতীয় সংসার রয়েছে, এ সকল চিন্তা করে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান। হযরত ফরিদপুরী পরবর্তীতে দ্বিতীয় স্ত্রীর চাচাত বোনকে বিয়ে করেন। (আগামীবারে সমাপ্ত)

ক্যাপশন
বিশ^ জাকের মঞ্জিল জামে মসজিদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট