চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দুর্যোগ মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগে চাই দুর্নীতিবাজ দমন

৭ মে, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

এখন চলছে দুর্যোগের মৌসুম। কালবৈশাখী, বজ্রঝড় এবং ঘূর্ণিঝড়সহ নানা দুর্যোগ হানা দিচ্ছে বারেবার। বেশকিছু মানুষের মৃত্যুও ঘটে গেছে ইতোমধ্যে। হয়েছে সম্পদহানিও। ঝড়বাদলের কাল বর্ষামৌসুম আসতেও খুব একটা দেরি নেই। আর পাহাড়-নদী-সাগর বেষ্টিত চট্টগ্রামে বর্ষামৌসুম মানেইতো জলাবদ্ধতা এবং পাহাড়ধসের পুরনো আতঙ্ক ফিরে আসা। যদিও প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বর্ষামৌসুম শুরুর আগেভাগেই নগরীর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়ার অভিযান শুরু করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাতে কি কাক্সিক্ষত ফল আসবে? অবৈধ বসতিব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনের খামখেয়ালি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বেপরোয়া আচরণ, সব মিলিয়ে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার অভিযান সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায় না। পরিণামে পাহাড়ধসে মানবমৃত্যুর করুণ দৃশ্য দেখতে হয় প্রতি বছর। এবার যে তার ব্যতিক্রম হবে, এমনটি ভাবা কঠিন। ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকেই যাচ্ছে।
পাহাড়ধসে মৃত্যু যেন একটি অপরিবর্তনীয় চক্রাকার নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে শতাধিক মানুষের জীবন্ত সমাধি হলে কারণ ও সমাধান নির্ণয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশও পেশ করেছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু একযুগ পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিলও বন্ধ হয়নি। প্রতি বছর বর্ষামৌসুমে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা গেলেও পাহাড়ধসে মানবমৃত্যু রোধ করা যায় না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পাহাড়ে বসবাসকারীদের যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগকর। সভায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, নগরের সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ১৭টি পাহাড়ে এখনো বসবাস করছে ৮৩৫টি পরিবার। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব পাহাড়ে অবৈধভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগও দেয়া হয়েছে। এমনকী কয়েকটি পাহাড়ে সরকারি টাকায় প্রকল্প গ্রহণ করে সড়ক ও ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, এসবের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী মহল। আর তাদের দাপটেই বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। এদের দাপটের কাছে প্রশাসন অসহায়। শনিবার প্রকাশিত একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, নগরীর আকবর শাহ থানার ফয়’স লেকের কনকর্ড সি-ওয়ার্ল্ডের পেছনে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এসময় বিদ্যুৎবিভাগের দু’টি গাড়ি ভাঙচুরের শিকার হয়। আকবর শাহ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহিবুর রহমান বলেছেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের সরানোর জন্য বিদ্যুতের লাইন কাটতে গেলে পিডিবি কর্মীদের ওপর হামলা হয়। এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে অবৈধ বসতিতে বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ হলো কীভাবে তার যুক্তিপূর্ণ জবাবও চাই আমরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আইন ও নীতির প্রশ্নে অটুট থাকতে পারলে কি পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে অবৈধ বসতিবাণিজ্যের বিস্তার ঘটতে পারতো?
একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, একটি স্বার্থান্বেষী চক্র সবসময় পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানোর কাজে বাধা দিয়ে থাকে। তারা পুনর্বাসনসামগ্রী চুরি, এমনকি পুনর্বাসন কাজ বন্ধ করে দিতেও নাকি নানা ফন্দি-ফিকির করে থাকে। এরা কারা তা প্রশাসন ভালোভাবেই জানে। যারা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ উপায়ে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি নির্মাণ করে উন্মুল জনগোষ্ঠীর কাছে ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং নিচ্ছে, মূলত তারাই এ পুনর্বাসন কাজ ভ-ুলের অপচেষ্টা চালায়। তাদের কাছে অসহায় মানুষদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। টাকাই তাদের কাছে সব। তারা শুধু সন্ত্রাসী কায়দায় পাহাড় দখল করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বানিয়ে ভাড়া দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, পাহাড়ের মাটিও বিক্রি করে দিচ্ছে ইটভাটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির কাছে। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ হুমকিতে পড়লেও তাদের কিছুই যায়-আসে না। টাকাই তাদের কাছে মুখ্য। আর প্রশাসনের নির্লিপ্ততা তাদের অবৈধ কাজে উৎসাহ যোগায়। জনস্বার্থে এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। আশার কথা হচ্ছে, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ১৫ দিনের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১৭টি পাহাড় অবৈধ দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যত প্রভাবশালীই হোক, কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না কাউকে। প্রশাসনের এই কঠোর অবস্থান শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে কিনা তা দেখার বিষয়। যদি অটুট থাকে তাহলে পাহাড়ধসে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমরা পাহাড়ধসে মৃত্যুর মতো আর কোনো অনভিপ্রেত মৃত্যুর ঘটনা দেখতে চাই না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট