চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কারবালার ঘটনার প্রেক্ষাপট

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ তায়ালার একান্ত ইচ্ছায় পৃথিবীর শুরু থেকে বড় বড় ও অলৌকিক ঘটনাগুলো ঘটেছে পবিত্র মহররমের দশ তারিখ আশুরা দিবসে। ৬১ হিজরি (৬৮০ খ্রি.) সনের সেই আশুরার দিবসে কারবালার বিয়োগান্ত ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। শেষ নবি (দ.)-এর প্রিয় দৈহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (র.)-এর সপরিবারে উক্ত দিবসে শাহাদাত বরণ করা এ কথা প্রমাণ করে যে, পূর্বের ধারাবাহিকতায় এ ঘটনাও অলৌকিক। এটি আল্লাহ তায়ালার নিকট ইমাম হুসাইন (র.)-এর উচ্চ মর্যাদার প্রমাণও বটে (ইমাম গজ্জালি, মুকাশিফাহ, পৃ. ৪৬০ )। এর দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, ইমাম হুসাইন (র.) সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাঁর সংগ্রামও সঠিক ও যথাযথ ছিল। চরম অত্যাচারিত হয়ে মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণ ছিল তাঁর বড় কারামাত।

মূলত কারবালা ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল হযরত উসমান (র.)-এর শাহাদাত এবং তাঁর শাহাদাতের বিচারকে কেন্দ্র করে। সদ্য খেলাফত প্রাপ্ত হযরত আলি (র.) হযরত উসমান (র.) হত্যার বিচারকার্য বিলম্বিত করছেন বা এতে গড়িমসি করছেন- এমন মনে করে মুসলমানদের একদল তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন। সেটাকে রূপ দেয়া হয়েছে জাহিলি যুগের সেই বনু হাশেম ও বনু উমাইয়ার হিংসাত্মক সম্পর্কে। যার ফলে উষ্ট্রীর যুদ্ধ (৩৬হি/৬৫৬ খ্রি.) এবং সিফফিনের যুদ্ধ (৩৭ হি./৬৫৭ খ্রি.) সংঘটিত হয়েছিল। এভাবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আল্লাহর নবি (দ.)-এর ন্যায়পরায়ণ সাহাবিগণ র.-এর মধ্যে কিছুটা অনাস্থা, অবিশ্বাস ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। খারেজিদের হাতে হযরত আলি (র.)-এর শাহাদাতের মাধ্যমে তা আরো বেশি প্রতিষ্ঠা পায়। হযরত আমির মুয়াবিয়া (র.) স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে ৬০ হি. সনে খেলাফতের অসিয়ত করে যাওয়ার মাধ্যমে তা ষোলকলায় পরিপূর্ণতা লাভ করে। তবে হযরত মুয়াবিয়া (র.) একজন সাহাবি। তখনকার রাজনৈতিক তথ্যগুলো তেমন নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায় না। আবার যা পাওয়া যায় সেগুলো সাংঘর্ষিক ও আবেগআশ্রিত। এসব কিছুর বিবেচনায় ইমামগণ হযরত মুয়াবিয়া (র.)-কে এ বিষয়ে দোষারোপ করেন না এবং জায়েযও মনে করেন না। হকপন্থী ইমামগণের মতে, তাঁর সমালোচনাও জায়েয নেই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মুসলামানদের এমন বিভাজন, দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ-বিগ্রহের পেছনে বিজাতীয় কপট শ্রেণির জোরালো ইন্ধন ও ভূমিকা ছিল। আব্দুল্লাহ বিন সাবা তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

ইয়াজিদ (৬০-৬৪ হি.) খলিফা হয়ে পূর্বসূরীদের বিপরীতে শাসন পরিচালনা শুরু করায় তার প্রতি মক্কা ও মদিনার মানুষ সমর্থন দিতে অস্বীকার করে। অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরাও তাকে সাদরে গ্রহণ করেননি। কেউ ভয়ে আবার কেউ ফিতনা আশংকায় ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কথা না বললেও হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (র.) সহ অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি সোচ্চার ছিলেন। সাহাবি হযরত নুমান বিন বশির (র.) কুফার গভর্নরের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। নবিপরিবারের সিনিয়র সদস্য হিসেবে ইয়াজিদের কুকীর্তির সমর্থন দেয়া হযরত ইমাম হুসাইন (র.)-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবার হযরত হাসান ও হযরত মুয়াবিয়া (র.)-এর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ীও ইয়াজিদ খলিফা হওয়ার কথা নয়। পূর্বের কোন খলিফা সে পদ্ধতিতে নির্বাচিত হননি। এ সব কারণে ইয়াজিদের খেলাফত প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং তার কুকীর্তি ও দুঃশাসন তাকে আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে। এভাবেই অনিবার্য হয়ে উঠে কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার। যদিও একাধিক হাদিসে কারবালায় তাঁর শাহাদাতের ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে এবং সেটিই হতে যাচ্ছিল- তবুও কারবালার প্রেক্ষাপট ছিল এমনিই। অপরদিকে কুফাবাসীর আবেদন ইমাম হুসাইন (র.) উপেক্ষা করতে পারেননি। অত্যাচারিত জনগণের আর্তনাদ উপেক্ষা করে নিশ্চুপ বসে থাকা নবিপ্রতিনিধির জন্য সমীচীনও ছিল না; যদিও ফিতনা এড়াবার লক্ষ্যে তিনি পবিত্র মদিনা ছেড়ে প্রথমে মক্কা শরিফ গিয়ে অবস্থান করতে চেয়েছেন।

কিন্তু দিন দিন ইয়াজিদের কুকীর্তি বৃদ্ধি ও কুফাবাসীর চিঠির পর চিঠি এবং বিভিন্ন দোহাই দিয়ে তাঁদের আবেদন উপেক্ষা করে নিজে আরামে জীবন কাটানোকে বৈধ মনে করেননি তিনি। কুফাবাসীর চিঠির একটি ভাষা এমনও ছিল যে, আমাদের এমন কঠিন সময়ে যদি আপনি না আসেন আর আমাদেরকে ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে হয় তাহলে আমরা কিয়ামত দিবসে আপনার নানাজানের নিকট আপনার বিরুদ্ধে বিচার দেব। কুফাবাসীর আবেদনের বাস্তবতা যাচাই এর জন্য তিনি চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আকিল (র.)-কে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও ইতিবাচক জবাব লিখেন। এমন প্রেক্ষাপটে ইমাম হুসাইন (র.) সপরিবারে কুফার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন। কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত হলে ইয়াজিদের নিয়োগপ্রাপ্ত কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ তাঁর মোকাবেলার জন্য চার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে দেয়।

ইমাম হুসাইন (র.) যুদ্ধ এড়াবার জন্য তিনটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু কুখ্যাত ওবায়দুল্লাহ সেগুলোর কোনটি গ্রহণ না করে ইয়াজিদের পক্ষে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে চাপ দেয়; যা মেনে নেয়া ছিল ইমাম হুসাইন (র.)-এর পক্ষে অসম্ভব। কারণ, ইয়াজিদের হাতে হাত দেয়া তথা তাকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া মানে আল্লাহর নবি (দ.)-এর সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনকে অবমাননা করা, সুপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক খেলাফত ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করা, স্বৈরাচারী শাসনকে স্বীকৃতি দেয়া এবং বহু কুকীর্তির ধারক-বাহক ইয়াজিদকে সমর্থন দেয়া। এক কথায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নবিপরিবারের সদস্য কর্তৃক কবর দেয়া।
তাই তিনি পার্থিব জীবনের মায়া ছেড়ে জীবনের বিনিময়ে সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার শপথে সুদৃঢ় থাকলেন। দুধের শিশুকে কুরবানি দিতেও কুন্ঠাবোধ করলেন না। এ কুরবানির মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য উত্তম মডেল হয়ে গেলেন। কিয়ামত অবধি যারা সত্যের সংগ্রাম করবেন তিনি তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। তাঁর পরিবারের ত্যাগ ভাস্বর হয়ে থাকবে মজলুম মানুষের জন্য। সুন্দর, সুস্থ্য ও কল্যাণকর যে কোন কিছু প্রতিষ্ঠার পেছনে ত্যাগই হবে প্রথম পাথেয়- এটাই তিনি প্রমাণ করলেন। তাঁর এমন অবিচলতা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণনা করে খাজা আজমিরি রহ. বলেন, “আসল রাজা ও বাদশা ইমাম হুসাইন, ইমাম হুসাইনই দ্বীন; দ্বীন রক্ষা করেছেন ইমাম হুসাইন। শির দিয়েছেন কিন্তু ইয়াজিদের হাতে হাত দেননি। বাস্তবতা হলো ইমাম হুসাইন “লা-ইলা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কালিমার প্রতিষ্ঠাতা”।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খতিব, চবক আ/এ জামে মসজিদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট