চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশুদের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই

মুসলেহউদ্দিন মুহম্মদ বদরুল

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

গত ৩ আগস্ট ২০১৯ আমার ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। ‘আগেকার দিনে সন্ধ্যা বেলায় শিশুরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনায় বসতো। বিপদ মুক্তির জন্য অধুনা বিলুপ্ত সেই রেওয়াজটা প্রত্যেক ঘরে চালু হোক।’ আলহামদুল্লিাহ, প্রদত্ত অতি ক্ষুদ্র স্ট্যাটাসটিকে সমর্থন জানিয়ে আমার অনেক বিজ্ঞ ফেবু বন্ধু আরও বিশদভাবে তাঁদের মতামত দিয়েছেন। মওলানা মুসলেহ্উদ্দিন আহমদ আল মাদানী লিখেছেন, সেইজন্য আল্লাহপাক মানুষকে এত বরকত দান করতেন। কেননা আল্লাহপাক মাছুম বাচ্চাদের দোয়া ও কোরআন শরীফ তেলাওয়াত সাথে সাথে কবুল করে নিতেন। তাই এত বা লা-মুছিবত থেকে দুনিয়াবাসি রক্ষা পেতেন।’ বন্ধু সেলিমউদ্দিন লিখেছেন, ‘তখনকার সময়ে সন্ধ্যা বেলায় মায়েরা বলতেন, হাতমুখ ধুয়ে আল্লাহকে ডাকতে বসো। আমি নিজেও ডেকেছি, এখনো সেদিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ইলমী জাহাঙ্গীর লিখেছেন, সেদিন কলেমা-দরুদ পাঠসহ প্রার্থনা করতাম, ‘আল্লাহ রিজিকে বরকত দে। আগুন-পানি-বিপদ-আপদ-বালা-মুসিবত থেকে পানাহ্ দে, বাবার আয়-রুজিতে বরকত দে। বাচ্চাদের সেই সুমধুর প্রার্থনায় এক স্বর্গীয় পরিবেশ-এর আমেজ দেখা যেত।

সৈয়দ এরশাদ লিখেছেন, সকাল বেলা মক্তবে যাওয়া, মাগরিবের পর উচ্চৈস্বরে দোয়া-দরুদ পড়া, আল্লাহকে ডাকার রেওয়াজ ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সন্তানদের জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখত। আজকের এই সামাজিক অনাচারের জন্য সেইসব চিরায়ত ধর্মাচারের প্রতি উদাসীনতাও অনেকাংশে দায়ী।’ মোহাম্মদ ইউসুফ লিখেছেন, ‘এখন আর বাচ্চাদেরকে মক্তবে পাঠানো, সন্ধ্যায় দরুদ পাঠ, নীতি বাক্য শেখানো, আল্লাহকে সব সময়ই স্মরণে রেখে প্রতিটি কাজ সমাধা করা, এ জীবনই শেষ নয়, পরকালের জীবনই আসল জীবন, এ সমস্ত নীতিকথা শেখানোর রেওয়াজ বাদ দিয়ে শুধুই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড় সাহেব বানানোর কাজে সমস্ত শক্তি ব্যয় করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে তারা বড় হয়ে চরম স্বার্থপর, আল্লাহ খোদার ভয়হীন এক অমানবিক, অসামাজিক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠে। তাই এরা মা-বাবাকে ব্দ্ধৃাশ্রমে পাঠানো কোন পাপ বা অপরাধ বলে মনে করে না। কারণ ঐ মা-বাবারই তো পাপ কি জিনিস, আল্লাহ কে? এসবের কিছুই শেখাই নি।’

আজিজউল্লাহ লিখেছেন, ‘মাগরিবের আগে হারিকেন জ¦ালিয়ে দিত মায়েরা। আমরা আল্লাহ আল্লাহ ডেকে পড়ার টেবিলে বসতাম। আর এটি ছিল আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের একটি অংশ।’ নেজামউদ্দিন লিখেছেন, মডারেট করতে গিয়ে ফোরকানিয়া শেষ। সতর ডাকতার বদলে সতর প্রদর্শন ইউনিফর্ম। বক্তারা বক্তব্য দেন, আপনার ছেলে মেয়ে কে মাদরাসায় পড়ান। অথচ, নিজের সন্তানকে পড়ান ইংলিশ মিডিয়ামে। অপরের মাথায় নুন রেখে কুল খাওয়ার মতো অবস্থা। কাজী মামুন লিখেছেন, সন্ধ্যা হওয়ার আগে চাচাতো জেঠাতো ভাই-বোনেরা সবাই সারিবদ্ধভাবে বসে আল্লাহকে ডাকতাম।
আমার উল্লেখিত বিজ্ঞ ফেবুবন্ধু সকলের মন্তব্যের সার কথাই হচ্ছে, একটি সুখী-সুন্দর, সমৃদ্ধ প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে শিশুদের জন্য পারিবারিকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা ও নৈতিকতা পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আজ আমাদের সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অপরাধ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে, নৈতিকতা শব্দটি অভিধান থেকে হারিয়ে গেছে। পিতা-মাতা পাচ্ছেননা সন্তানের সেবা, শিক্ষক পাচ্ছেননা তাঁর প্রাপ্য সম্মান, শিক্ষার্থী পাচ্ছে না সঠিক শিক্ষা। যার একটাই কারণ, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব।

সততা, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র এ সবকিছুর সমন্বয় হলো নৈতিকতা। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাল-চলন, ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি বলে। তাই নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যার চরিত্র উত্তম’ (বুখারী ও মুসলিম)
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন – মুমিনের পরিমাপদ-ে কিয়ামতের দিন উত্তম নৈতিক চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী জিনিস আর কিছু নয়।’ (তিরমিযী)

নৈতিকতা হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। আর এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা।
ধর্মীয় শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো – মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া। নৈতিকতা হীন মানুষ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন – তাদের হৃদয় আছে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে দেখে না, কান আছে শুনে না। এরা হলো চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। আর এরাই হলো গাফিল। (সূরা আরাফ, আয়াত- ১৭৯)। বস্তুত নৈতিকতা হলো মানুষের সবচেয়ে উন্নত গুণ ও বৈশিষ্ট্য।

অথচ, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আজ মানুষের হৃদয়বৃত্তি পশুবৃত্তিতে রূপ নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে, সমাজ ও পরিবারে ভাঙনের করুণ বিউগল বেজে উঠেছে। পবিত্র সম্পর্ক গুলোতে চিড় ধরেছে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে পারছে না কেউ। ফলে বেড়ে চলে পরকিয়া, খুন-ধর্ষণ, আত্মহত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা। পারিবারিক বন্ধনের স্বর্গীয় জায়গাগুলোতে গভীর ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ^াস। আর এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমময় সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। ক্ষেত্র বিশেষে বলি হচ্ছে নাড়ি ছেঁড়া সন্তান-সন্ততি। সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুখ-শান্তি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেশের ভবিষ্যত যুবসমাজ। নৈতিকতাহীন শিক্ষায় তারা দূরে সরে যাচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া থেকে। হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মাদকাসক্ত, ধর্ষক, ইভটিজার, সন্ত্রাসী। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনাগুলোতে অবক্ষয়ী সমাজের চিত্রই ফুটে উঠেছে। স্যাটেলাইটের সুবাদে উন্মুক্ত অপসংস্কৃতির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত দেশীয় সংস্কৃতি। মোবাইলে ইন্টারনেট চালানো সহজ হওয়ায় তরুণ সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরাও ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার কল্যাণের নামে অকল্যাণ বয়ে আনছে। ফলে নৈতিক শিক্ষার অভাবে জাতি আজ এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের কবলে পড়ছে। তাই, আবারও বলছি, শিশুদের জন্য পারিবারিকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক, নির্বাহী সম্পাদক, মদীনার আলো।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট