চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্মরণ : সমাজসেবী আবু তাহের চৌধুরী

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

দুনিয়ার সব মানুষকে চলে যেতে হবে, সেই সত্তার কাছে-যিনি এই বিশাল আকাশ-জমিনের একচ্ছত্র মালিক, তিনি আর কেউ নন গোটা সৃষ্টিকূলের রব মহান রাব্বুল আলামিন। ‘কারো (নির্ধারিত) সময় যখন এসে যাবে তখন আল্লাহ্তায়ালা কখনোই তাকে (এক মুহূর্ত) অবকাশ দেবেন না; তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) যা কিছু করছো, আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন’- সূরা আল্-মুনাফেকুন- আয়াত ১১। সমাজসেবী আবু তাহের চৌধুরী ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্বজনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে যান মহান রবের সান্নিধ্যে। খুবই পরিশ্রমী ও কঠোর অধ্যবসায়ী স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। দুনিয়ার জীবনে কঠোর সংগ্রাম করেছেন-শূন্য থেকে বিশালতায় স্থান করে নিয়েছেন খুব অল্প সময়ে। প্রতিষ্ঠা করেছেন বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান-এতে ঠাঁই হয়েছে বহু শ্রমজীবী মানুষের। উনি আমার বড় ভাই। ওনার সাথে আমার বহু স্মৃতি আছে।

কখনো কখনো নীরবে কাঁদি-কান্নার সাগরে অবচেতন মনে নিজেকে বিলিয়ে দিই। পৃথিবীর সমস্ত কান্না আমার ভেতর ধুক ধুক করছে। প্রাইমারী পাঠ শেষে বড় স্কুলে ভর্তি হওয়ার অদম্য বাসনা নিয়ে ছুটছি তাঁর হাত ধরে-এ কথা মনে হতেই বেদনার হুল্লোড় বয়ে যায় ইথারে ইথারে। বড় ভাইয়ের শাসন মেনে নিয়েছি মাথা পেতে- কখনো তর্কে জড়াইনি পিতৃতুল্য ভাইয়ের সাথে। হিংগলা মুছাশাহ্ প্রাথমিক বিদ্যালয়- রাউজান ছালামত উল্লাহ্ উচ্চ বিদ্যালয়- সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ- বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স এন্ড সার্জন্স- ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর পাঠ চুকে আজকের এই অবস্থানে আমি। এসবের পেছনে রয়েছে আমার ভাইয়ের বিশাল অবদান।

এই নশ্বর দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর কথা শুধু মনে পড়ে, পরিবারের সবাইকে আগলে রাখতেন যিনি সর্বদা। এ মানুষটি ছিলেন মিতভাষী, প্রখর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, অত্যন্ত মেধাবী। এভাবে আমাদেরকেও চলে যেতে হবে সেই বিশাল স্থায়ী জীবনের ক্যাম্পাসে। ‘মৃত্যু যন্ত্রণার মুহূর্তটি (যখন) এসে হাজির হবে (তখন তাকে বলা হবে) এ হচ্ছে সে (মুহূর্ত)-টা, যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে’-সূরা ক্বাফ-আয়াত ১৯। প্রতিটি মুহূর্ত আমরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পথ চল্ছি। যে কোনো মুহূর্তে আমাদেরকে চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে-যেন মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে চল্ছি। কেউ বা সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউ বা স্ট্রোকে, কেউ বা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে প্রতিদিন-মৃত্যুর মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। এ মিছিল যেন থাম্ছে না। আমার বড় ভাই মরহুম আবু তাহের চৌধুরীর জীবনটা ছিল অত্যন্ত সাদামাটা।

জীবনের বাঁকে বাঁকে কঠিন উদ্বেগ আর আবেগ এর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। সামাল দিয়েছেন অত্যন্ত সুনিপুণ হস্তে। নিরহংকার আর পরোপকারী এ মানুষটি আর আমাদের মাঝে কোনদিন আসবে না-এটি ভাবতেই যেন গা শিউরে উঠে। আজ মনে পড়ছে সেই দিনের কথা, যে দিন তাঁর দাফন শেষে কবর পাড়ে আমার সেজ ভাই আবুল কাশেম কবরের মাটি ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন-তাঁকে আমরা কেউ সান্তনা দিতে পারিনি। কঠিন আবেগে বার বার যেন হারিয়ে যাই নিঃসীম নিবাসে। আমার ভাইয়ের ছেলেরা কি ধরে রাখতে পারবে তাদের পিতার মর্যাদা? ‘যে সব মানুষ (আল্লাহর উপর) ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানরাও এ ঈমানের ব্যাপারে তাদের অনুবর্তন করেছে, আমি (সেদিন জান্নাতে) তাদের সন্তান-সন্ততিদের তাদের (নিজ নিজ পিতা মাতার) সাথে মিলিয়ে দেব, আর এ জন্যে আমি তাদের (পিতা-মাতার) পাওনার কিছুই হ্রাস করব না, (বস্তুত) প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ কর্মফলের হাতে বন্দি হয়ে আছে’-সূরা আত্-তুর-আয়াত ২১। আবারও মনে পড়ছে সেই দিনের কথা যেদিন ধীরে ধীরে কদমে কদমে এগিয়ে যাই কবর স্থানের দিকে, নিজের কাঁধে করে পদযাত্রা লাশবাহী কফিন, বড়ো কষ্ট-অনেক বড়ো কষ্ট, এ কষ্টের কোন সীমারেখা নেই, অনিয়ন্ত্রিত সাহসের কাছে যেন হার না মানি।

মনে পড়ে তাঁর অব্যক্ত পংক্তিমালা, উপদেশ, নির্বাচিত শব্দের শহর। ডুকরে কেঁদে ওঠি অবিরত। ভেতরটা যেন ধড়পড় করে ওঠে। আমাদের সাহস যোগাবে কে? মাথার উপর থেকে সুবিশাল ছায়াটা চিরতরে হারিয়ে গেল। কফিন রাখলাম বাবা-মা’র কবরের খুব কাছাকাছি। মাটির রাজ্যে বসবাস একজন মানুষের, মাটি দিয়ে গেঁথে দিলাম পরপারের চিহ্ন, সেঝ ভাইয়ের কান্না যেন থামতেই চায় না, বিন্দু বিন্দু জলরাশিতে ছেয়ে যায় আমার অভিভাবকতুল্য বড় ভাইয়ের কবরের উচ্ছল শরীর। এই তো বিদায়-৪০ কদম পেরুতে না পেরুতেই শুরু হয়ে গেল মুনকার-নাকিরের শওয়াল-জওয়াব। ৬৫ বছরের এ মানুষটি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন চিরকালের জন্যে, আসবে না আর কোনদিন এ অঞ্চলে, এ আড্ডায়। নিয়ে গেলেন ওনার নেক আমল, সৎকর্ম, ছদকা, দান খয়রাত ইত্যাদি। নিয়ে যাননি কোটি কোটি টাকার কষ্টার্জিত সম্পত্তি। রেখে গেলেন হাজারো দিনের স্মৃতি। মহান রাব্বুল আল্-আমিন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন (আমিন)।

লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট