চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্মরণ : আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী (রহ.)

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে বার আউলিয়ার চট্টগ্রামের বাকলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী (আলায়হি রাহমাতু রাব্বিহিল বারী) হলেন আল্লাহর এমনই বিশেষ নি’মাতপ্রাপ্ত ক্ষণজন্মাদের একজন। জন্মসূত্রে তাঁর মধ্যে ছিলো অসাধারণ মেধা ও প্রতিভা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা আরম্ভ করার পূর্বেই তিনি পৈত্রিকব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেও তার মেধা, শ্রম, অধ্যবসায়, তীক্ষèèবুদ্ধি ও দূরদর্শিতা বলে জীবনের এক পর্যায়ে তিনি এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় আসীন হন। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত অসাধারণ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে যেতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অগণিত অবদানের মাঝে অমর, স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। তাঁর ওইসব গুণের সাথে সংযুক্ত হয়েছে তাঁর প্রতি আপন মুর্শিদ ও গাউসে যমানের কৃপাদৃষ্টি, যা তাঁর জীবনে এনে দেয় অকল্পনীয় পূর্ণতা।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৭৪ হিজরির ১৯ মুহররম আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী বাকলিয়ার এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পৈত্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন। সুতরাং অল্প সময়ে তিনি পুরো চট্টগ্রামে এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বক্সিরহাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি, চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সম্মানিত সদস্য, চট্টগ্রামের ভোজ্যতৈল ও তুলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাস্ট সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে খ্যাত হন। এমনকি তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে পূর্বপাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের দাবী-দাওয়া আদায়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত, রাজনীতির অঙ্গনেও তিনি এক বিশেষ পদমর্যাদায় আসীন হন। তিনি ছিলেন জনদরদী, প্রসিদ্ধ সমাজসেবকও। তিনি জমিয়াতুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদের বোর্ড অফ গভর্নরস্ এর সদস্য ও হজ্জ্ব কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী নিজে যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুভব করেছেন। সুতরাং তিনি চট্টগ্রাম শহর এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। তিনি লামাবাজার, চরচাক্তাই বালক উচ্চবিদ্যালয়, গুলজার বেগম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এবং বাকলিয়ার প্রসিদ্ধ ফোরক্বানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (চট্টগ্রাম), জামেয়া ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (ঢাকা) এবং হালিশহর ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসাসহ বহু দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রাখেন এবং এগুলোর আজীবন অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শরীয়ত, ত্বরীকত, বর্তমানে সারাদেশে শতাধিক মাদ্রাসার পরিচালনাকারী, বহু আধ্যাত্মিক সংগঠন, যেমন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ, অনেক ধর্মীয় যুগোপযোগী গ্রন্থপুস্তক ও আহলে সুন্নাতের একমাত্র মাসিক মুখপত্র ‘তরজুমান-এ আহ্লে সুন্নাত’ ইত্যাদির পরিচালক ও প্রকাশক সংগঠন আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার আজীবন সহ-সভাপতি ছিলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী। তিনি স্ব-উদ্যোগে যে জ্ঞান-ভান্ডার আয়ত্ব করেছিলেন তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁর কথাবার্তা, বক্তব্য ও যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
যথাসময়ে কামিল মুর্শিদের হাতে বায়’আত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কামিল মুর্শিদ তাঁর নিষ্ঠাবান মুরীদকেও কামিল করে দিতে পারেন। ইসলামি জগতে এর উদাহরণ প্রচূর। তাই কামিল মুর্শিদের সন্ধান করা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ, তেমনি যথাসময় তাঁর হাতে বায়’আত গ্রহণ করে তাঁর নির্দেশানুসারে অনুশীলন করাও সৌভাগ্যের কারণ। আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর মধ্যে এ উভয়েরই সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি যথাসময়ে উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ মুর্শিদে বরহক্ব আওলাদ-ই রসূল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (ওরফে হযরত পেশোয়ারী সাহেব) আলায়হির রাহমাহ্র হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে ‘ফানাফিশ্ শায়খের’ মর্যাদায় উন্নীত হন। ইতোমধ্যে তিনি শরীয়ত, ত্বরীকত, বিশেষত আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। সিলসিলাহ্-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার জন্য তিনি যে অসাধারণ অবদান রাখেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় এতে যে, তাঁর মহান মুর্শিদের সুযোগ্য উত্তরসূরী মাদারাযাদ ওলী মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহ.) তাঁকে খিলাফতের মহামর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর নামের সাথে ‘সওদাগর’ -এর স্থলে ‘আলক্বাদেরী’ও শোভা পেতে থাকে। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলক্বাদেরী হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট ও হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমা)’র দীর্ঘ সান্নিধ্য পান এবং তিনি তাঁদের ইচ্ছা, ইঙ্গিত ও ভেদ অনুধাবনে পারদর্শী ছিলেন।
আন্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার তিনি সর্বপ্রথম সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ নিজ বাসভবনের পূর্ণ একতলা খানক্বাহ্ শরীফের জন্য ওয়াক্বফ করে দেন ও নিজ খরচে পরিচালনা করেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি আপন মহান মুর্শিদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার এমন পরামর্শ সভায় বাঁশ-বেড়া ও টিনের ছাউনী কিংবা সেমিপাকা ঘর তৈরীর প্রস্তাবাবলী উপস্থাপিত হলে হুযূর ক্বেবলা তাতে রাজি হননি। হুযূর ক্বেবলার ইচ্ছা যে প্রথম থেকেই জামেয়া একটি মনোরম পাকা দালানেই প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সাথে সাথে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামেয়ার জন্য পাকা দালানই হবে আর যাবতীয় রড-সিমেন্ট তিনিই প্রদান করবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করলেন। এতে হুযুর কেবলা অত্যন্ত খুশী হন এবং বিশেষভাবে দো’আ করেন। এভাবে জামেয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। আর আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী আজীবন জামেয়া-আন্জুমানের সর্বোচ্চ খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। মোটকথা হুযূর কেবলার শরীয়ত ও ত্বরীকত সমন্বিত অনন্য সুন্দর এ মিশনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যান এ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া (ঢাকা)’র প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জশনে জুলুসের প্রবর্তনের গোড়ায়ও আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রর্বতিত বিশাল জশনে জুলুসের প্রথম দু’ বছর তিনিই নেতৃত্ব দেন।

ত্বরীকতের ক্ষেত্রে আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী সকলের নিকট শুধু শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন না বরং সকলের হৃদয়ে তিনি অকৃত্রিম ভালবাসার স্থানও করে নিয়েছিলেন, যা তাঁর ইন্তিকালের সময় প্রকাশ পেয়েছিলো। তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৪০০ হিজরির ১৯ মহররম ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে অগণিত পীরভাই-বোন, সর্বস্তরের জন সাধারণ ও জামেয়ার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেদিন তাঁকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য এবং তাঁর নামাযে জানাযায় শরীক হবার জন্য অগণিত মুসল্লী অশ্রুসিক্ত নয়নে ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁর বাসভবন এলাকায় সমবেত হন। তখনই সহজে অনুমিত হয়েছিলো তার অসামান্য জনপ্রিয়তা। জামেয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জানাযা নামাযের পর তাঁকে জামেয়ার পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। এখানে তাঁর মনোরম সমাধি রয়েছে যাতে অগণিত মুসলমান নিয়মিত যিয়ারত করে ধন্য হন।

তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত ধর্ম ও ইবাদতপরায়ণ ছিলেন। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যগণ, বিশেষত: তাঁর উত্তরসূরী সন্তানগণ এবং আত্মীয়-স্বজনকেও হুযূর ক্বেবলার সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন এবং সিল্সিলার পুণ্যময় কর্মকা-ে রিয়াযতে রত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর সুযোগ্য সন্তান আলহাজ মুহাম্মদ মহসিন সাহেবকে হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীরই পদে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। হুযুর কেবলা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন এ নিয়োগদান সিল্সিলার উর্ধ্বতন মাশাইখ হযরতেরই সিদ্ধান্ত। এ বরকতমন্ডিত নিয়োগপ্রাপ্তি থেকে আজ অবধি আলহাজ্ মুহাম্মদ মহসিন সাহেব ওই পদে সসম্মানে আসীন রয়ে জামেয়া, আন্জুমান আলমগীর খানকাহ শরীফ্, বলুয়ার দীঘিস্থ খানক্বাহ্ শরীফ ও সিল্সিলাহ্ আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটির ব্যাপক কর্মকা- সুচারুরূপে পরিচালনা করে আসছেন। তিনি তাঁর পিতার ন্যায় জামেয়া, আন্জুমান ও সুন্নী মতাদর্শ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এক অতন্দ্র ও আপোষহীন কর্ণধারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর সকল স্বনামধন্য উত্তরসূরী সন্তানগণ আপন আপন অবস্থান থেকে দ্বীন ও মাযহাবের উল্লেখযোগ্য খিদমত আন্জাম দিচ্ছেন।
মোটকথা, এসব কটি অঙ্গনে ও বিষয়ে এক অতি স্মরণীয় ও বরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে চির অমর হয়ে আছেন ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমী জনসাধারণের এ পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী রহমতুল্লাহি আলাইহি। আল্লাহ্ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন।

লেখক : মহাপরিচালক, আন্জুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট