চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিয়ন্ত্রণে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিন গ্যাং কালচারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নগরকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং কালচার ভয়ঙ্কর রূপ ধারণের খবরটি খুবই উদ্বেগকর। যেখানে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার জন্যে নিরাপদ সমাজ গড়ার তাগাড়া অনুভব করছেন সচেতন নাগরিকসমাজ, সেখানে তথাকথিত বড় ভাইদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং কালচারের অপ্রতিরোধ্য বিস্তারের খবর খুবই অস্বস্থিদায়ক বলতে হবে। মাদকনেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদকব্যবসা, এমনকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বা অন্য গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুনখারাবি থেকেও পিছপা হচ্ছে না এসব কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা। যদি এখনই প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়া যায় তবে তা মহামারীর রূপ নেবে, সন্দেহ নেই। এ ধরনের পরিস্থিতি নিশ্চয়ই শুভবোধসম্পন্ন কারো কাম্য নয়।

পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক উদাসীনতা, কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যবহারসহ নানা কারণে দেশে জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে কিশোর অপরাধ। দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোররা। খুনখারাবীসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট করছে তারা। গত দুই বছরে দেশে গ্রুপভিত্তিক কিশোর অপরাধের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। দৈনিক পূর্বকোণসহ বিভিন্ন সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো বলছে, পাড়ায়-মহল্লায় বিভিন্ন এলাকায় বিপথগামী কিশোররা বিভিন্ন নামে গড়ে তুলছে বিভিন্ন গ্রুপ। তারা স্কুলে যাওয়ার নাম করে ঘর থেকে বের হলেও স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিভিন্নস্থানে আড্ডা দেয়, স্কুলের সামনে ইভটিজিং করে, সন্ধ্যার পর আবাসিক এলাকায় উচ্ছৃঙ্খল আড্ডা আর নেশা করে, পাড়ার মোড়ে মোড়ে হৈ হুল্লোড় করে ও জোরে হর্ণ বাজিয়ে মোটরসাইকেল চালায়, মুরব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবী করে, তাদের অপকর্মে কেউ বাঁধা দিলে তাকে অপদস্ত করে, এমনকি খুন করতেও দ্বিধা করে না, এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে শত্রু বিবেচনা করে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্যে যে কোনো অপরাধ করতে তারা পিছপা হয় না। এ অবস্থা সমাজসচেতনদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নানা অপরাধে জড়ানো বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বড় ভাইদের স্বার্থের প্রশ্রয়ে হয়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। আবার কিশোর গ্যাংগুলোর তৎপরতা একসময় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে ছড়িয়ে পড়েছে ছিমছাম, নীরব জেলা-উপজেলা শহরগুলোতেও। নি¤œবিত্ত পরিবারের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানরাই প্রধানত এসব গ্রুপে যোগ দিচ্ছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই অপরাধী কিশোরগ্রুপগুলো সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা নষ্ট করে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।

উল্লেখ্য, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পরিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে সুস্থ রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্র দিনদিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে, দ্রুত বেড়ে চলেছে ভোগবাদী প্রবণতা। সমাজের একাংশ এতটাই ভোগবিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, এই সমাজে পারিবারিক কাঠামো থাকলেও তা নামমাত্র। ফলে বাবা-মা-সন্তানের মধ্যেও স্নেহের বন্ধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সন্তানদের সময় দেন না অনেক মা-বাবা। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কি করছে, সে খোঁজও রাখা হয় না। বিচ্ছিন্নতার পরিণামে সন্তানরা এক সময় গ্যাং কালচারে হারিয়ে যায়। তাছাড়া চলচ্চিত্র এবং সমাজবাস্তবতা থেকেও অপরাধের পাঠ নিচ্ছে কিশোর-তরুণরা। অনুকরণের মাধ্যমেও অনেক অপরাধ ঘটছে। কিশোরদের মধ্যে একটা অনুসরণ করার প্রবণতা থাকে। এই বয়সে তাদের মনে একটা অ্যাডভেনচারিজম কাজ করে। তারা যে কাজ করে আনন্দ পায় তা দ্রুত অনুসরণ করে। রাজনীতি কলুষিত হলে এবং সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেলে কিশোর মন খুব দ্রুত অপরাধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আবার কিশোর বয়সে অপরাধ করলেও আইনে তাদের শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। ফলে তাদের ওপর আইনের কঠোর প্রয়োগের সুযোগ নেই। ফলে রাজনৈতিক বড় ভাইদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাধাহীনভাবে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কিন্তু এর রাশ টানতে না পারলে সমাজ অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়ে পড়বে দ্রুত, বিফলে যাবে আমাদের সব অর্জন।

আমরা মনে করি, এ পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। পুলিশী অভিযান ও টহল জোরদার করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ ও সচেতনতা কর্মসূচি থাকলে, একইসঙ্গে পরিবারের অভিভাবকদের ইতিবাচক ভূমিকা থাকলে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সাফল্য আসবে। চিহ্নিত রাজনৈতিক ‘বড় ভাই’দের প্রতিহত করে পুলিশি অভিযান জোরদার করা গেলে, অভিভাবকরা সচেতন হলে সন্তানরা বিপথগামী হবে না। জানা গেছে, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে শক্ত পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামছে র‌্যাব। এটি আশার কথা, তবে কাক্সিক্ষত ফল পেতে এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন জোরদারেও বলিষ্ঠ কর্মসূচি থাকতে হবে। আমাদের বিশ^াস, সম্মিলিতভাবে চেষ্টা নিলে কিশোর গ্যাং নামক দুষ্টক্ষত থেকে সমাজ ও দেশ মুক্ত হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট