চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আগামিতে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতেই হবে

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করে দেশে প্রাইমারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন। গ্রামীণ জনগণের দুঃখ বেদনা তিনি অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন বলেই প্রাইমারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তিনি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল ধাপ হিসেবে বিবেচনা করে এরূপ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাইমারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অবহেলিত।

প্রতি ইউনিয়ন জনসংখ্যা ৩৭৩৩০ জন হলে চিকিৎসকের প্রয়োজন ১৪ জন। বর্তমানে প্রতি ইউনিয়নে চিকিৎসক আছেন ৫ জন। অতএব আরো প্রয়োজন (১৪-৫) বা ৯ জন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এ মুহূর্তে ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্রসমূহে ৪৫৫৪ ঢ ৯ বা ৪০৯৮৬ জন চিকিৎসককে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন।
নিচে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সংক্রান্ত আরো কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠক সমীপে পেশ করছি :
ক) বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা : তিনটি ধাপে বিভক্ত : ১) প্রাইমারী ধাপ : ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, ওয়ার্ড পর্যায়ে কম্যুনিটি ক্লিনিক, বেসরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পৌর ও সিটি কর্পোরেশন স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহ ২) সেকে-ারী ধাপ : জেলা পর্যায়ে অবস্থিত সরকারী হাসপাতালসমূহ, বেসরকারী পর্যায়ের হাসপাতাল সমূহ, পৌর ও সিটি কর্পোরেশন হাসপাতালসমূহ ৩) টারশিয়ারী ধাপ : জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অবস্থিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সমূহ, বেসরকারী পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহ।
খ) রোগীদের চিকিৎসা অর্থনৈতিক অবস্থা : বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্যব্যয়ে সরকারী ব্যয় সর্বনি¤œ এবং ব্যক্তিগত ব্যয় সর্বোচ্চ। মোট স্বাস্থ্যব্যয়ে সরকারী ব্যয় ভারতে ৩৩ শতাংশ, নেপালে ৪০ শতাংশ, বাংলাদেশে ২৩ শতাংশ। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তিগত ব্যয় ভারতে ৫৭ শতাংশ, নেপালে ৪৯ শতাংশ, বাংলাদেশে ৬৩ শতাংশ।
গ) সরকারী খাতে অপর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ : দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ^ব্যাংক নিরূপিত এক দশমিক শূন্য এক শতাংশ (১.০১ শতাংশ) ধরে বিআইডিএস একটি গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেছে। এতে প্রতি বছর ২৫২২ জনের বিপরীতে একজন করে চিকিৎসক ধরা হয়েছে। বর্তমানে সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ২৬১৫৩ জন। কিন্তু ২৫০০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক হিসেব করলে বর্তমানে সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক থাকা উচিৎ ১৭ কোটি জনগণের জন্য প্রায় ৬৮,০০০জন। অর্থাৎ সরকারের উচিৎ আরও ৪১৮৪৭ জন চিকিৎসককে এখনই নিয়োগ দেয়া। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সরকারী খাতে নিয়োগকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৩৮ শতাংশ। খ) অপর্যাপ্ত সেবাকর্মী নিয়োগ : প্রয়োজনের তুলনায় নার্স রয়েছে মাত্র ১৩.৩ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটে স্বাস্থ্যখাত : মোট বাজেটের পরিমাণ ৫২৩১৯০ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য বাজেট ২৫৭৩২ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৪.৯১ শতাংশ। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা খাতে ১৯৯৪৩ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৩.৮১ শতাংশ। এর মধ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৫৭৮৯ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১.১ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি দেখালেও বরাদ্দ কমেছে : স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের েেচয় ২৩৪৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৫.০৩ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমে গিয়ে ৪.৯১ হয়েছে, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিলো ৫.১৬ শতাংশ।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে বিরাদ্দ কমেছে :
এ বিভাগটি সরাসরি চিকিৎসার সাথে জড়িত। বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিলো মোট বাজেটের ৩.৯১ শতাংশ। বর্তমান ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তা কমে ৩.৮১ শতাংশ হয়েছে যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ছিলো ৪.০৪ শতাংশ।
দেশে জিডিপি-এর আকার বাড়লেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমেছে : বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি-এর কমপক্ষে ৫ শতাংশ ব্যবহার করা উচিৎ। সে অনুযায়ী এ বছরের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেয়া উচিৎ ছিলো ১২৬৮০৮ কোটি টাকা। কিন্তু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২৫৭৩২ কোটি টাকা।

স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমছে :
২০০৮-৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় মোট বাজেটের ৫.৭ শতাংশ ছিলো। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিলো ৫.১৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিলো ৫.০৩ শতাংশ। এবারের ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৯১ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে থাকে বাংলাদেশ

উপসংহার : এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসেবে উপসংহারে বলতে চাই যে, সীমিত বরাদ্দ দিয়েই স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ সুনাম অব্যাহত রাখতে এবং গৃহীত পরিকল্পনা সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ভবিষ্যতে বাড়াতেই হবে। অতঃপর প্রাইমারী স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজিয়ে সচল করার মাধ্যমে রোগীদের চাপে নিষ্পেষিত সেকে-ারী ও টারশিয়ারী স্বাস্থ্যখাত দুটিকে বিপর্যস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।

লেখক : চর্মরোগ ও ডায়াবেটিস-এ ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট