চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা ও এশিয়া অঞ্চল

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ

চতুর্দশ শতাব্দীতে নতুন দুনিয়া আবিষ্কারের জন্য ইউরোপের যে কয়েকটি দেশ প্রচেষ্টা চালায় তাদের মধ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন এবং পুর্তগালই ছিল প্রধান। পশ্চিমা জনগণের মধ্যে পুর্তগীজরাই সর্বপ্রথম আটলান্টিক মহাসাগরে অনুসন্ধানী তৎপরতা শুরু করেন। দশকের পর দশক ধরে তারা আফ্রিকার উপকূলের মানচিত্র অঙ্কন করে ১৪৮৮ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। অবশেষে ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-দা-গামা’র নেতৃত্বে তারা ভারতবর্ষে পৌঁছে। কিন্তু পর্তুগীজদের কেউই আমেরিকা আবিষ্কারে সক্ষম হয়নি। আমেরিকা আবিষ্কার করেন ক্রিস্টোফার কলাম্বাস। ইতালীতে জন্মগ্রহণকারী কলাম্বাস চাকুরী করতেন স্পেন সরকারের অধীনে। সমুদ্র অভিযাত্রায় তাঁকে সাহায্য করার জন্য তিনি বহু জায়গায় ধরণা দিয়েছিলেন। কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। অবশেষে স্পেনের রাজ-দম্পতি, ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার অর্থ আনুকূল্যে পর্যাপ্ত অর্থ ও সাজ-সরঞ্জাম যোগাড় করে কলম্বাস এশিয়া পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। তার এ অভিযানে শরিক হয়েছিল তিনটি পাল তোলা জাহাজ। দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত বাতাসের ধাক্কায় জাহাজগুলো এগিয়ে চলছিল পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে। অবশেষে ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর তাঁর জাহাজগুলো ডাঙায় গিয়ে ভিড়ে। যদিও তিনি মনে করেছিলেন যে, তিনি এশিয়ায় এসে ডাঙ্গায় ভিড়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন বিপুল ঐশ^র্য্যমন্ডিত, সুবিশাল এমন এক নয়া দুনিয়া যার সম্পদের প্রাচুর্য্যে পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে মানুষের কল্পনার সর্বোচ্চসীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নতুন দুনিয়ায় সর্বশেষ যে অভিযাত্রীদের আগমন ঘটে, ইংরেজরা ছিল তাদের অন্যতম। সা¤্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা থেকে রাজ্য দখল করার জন্য স্পেনের সাথে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ইংরেজদের ধারণা ছিল এ নতুন দুনিয়া তথা আমেরিকাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও ধনভান্ডার লুকিয়ে আছে। স্পেনীয়দের পরাজিত করতে পারলে এই বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হওয়া যাবে। এ ধারণা আরো বদ্ধমূল হয় যখন ইংরেজ ব্যবসায়ী স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলভাগে স্প্যানিশ বসতি এবং জাহাজে লুটতরাজ চালিয়ে সমুদ্রপথে গোটা দুনিয়া পাঁড়ি দিয়ে বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এ সাফল্যের জন্য তিনি রানী এলিজাবেথ কর্তৃক নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। পরবর্তীতে ইংরেজরা স্প্যানিসদের পরাজিত করে সম্পূর্ণ আমেরিকা দখল করে নেন।

কিন্তু বৃটেন কর্তৃক আমেরিকা দখল করার কারণে এবং নিজদের স্বার্থ আদায় করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন পাস করতে থাকে। ১৬৫১ সালে বৃটেন কর্তৃক প্রণীত নৌপরিবহন আইনে বলা হয় যে, আমেরিকা থেকে যেসব পণ্য বৃটেনে আমদানি করা হবে তার সবটাই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত জাহাজে করে পরিবহন করতে হবে। ১৬৯৯ সালে পশম আইনে বলা হয় যে, উপনিবেশগুলো একে অন্যের নিকট পশমজাত পণ্য রপ্তানি করতে পারবে না। ১৭৫০ সালে অপর আইনে উপনিবেশে লৌহ ও ইস্পাত দ্রব্য প্রস্তুত নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে উপনিবেশগুলোর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ কারণে বৃটেন ও আমেরিকার মধ্যে দ্বন্ধের সূচনা হয়। অবশেষে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। তবে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অন্তকোন্দল যে ছিল না তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে ক্রীতদাস প্রথা থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে আমেরিকার উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ১৭৭৬ থেকে ১৮৬০-এ দীর্ঘ ৮৫ বছর উভয় অঞ্চলের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ চলতে থাকে। অবশেষে ১৮৬০ সালে বিভেদের স্ফুলিঙ্গ বিস্ফোরিত হয়ে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। এ গৃহযুদ্ধ ৫ বছর কাল স্থায়ী হয়। ১৭৯০ সালে এক হিসেবে দেখা যায় সমগ্র আমেরিকায় দাসশ্রমিক ছিল প্রায় ৭ লক্ষ। তাদের প্রায় সকলেই দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করত। আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে ক্রীতদাস প্রায় ছিল না বললেই চলে। কারণ দক্ষিণাঞ্চলের জলবায়ু নিগ্রো দাসদের উপযোগী ছিল। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের জলবায়ু তাদের বসবাসের উপযোগী ছিল না। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান উপজীবিকা ছিল কৃষি। এ কাজের জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হত। বিশেষ করে তুলা ও তামাক উৎপাদনে পরিশ্রমী নিগ্রো দাসেরা ছিল খুবই উপযোগী। তদুপরি দাসশ্রমিক কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা কম ব্যয়সাধ্য ছিল। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চল দাসপ্রথা বজায় রাখার পক্ষে ছিল আর আমেরিকার উত্তরাঞ্চল দাসপ্রথা বজায় রাখার বিপক্ষে ছিল। ১৮৬০ সালে ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আব্রাহাম লিংকন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর গৃহযুদ্ধে নিহত আমেরিকানদের স্মরণে এক বক্তৃতা প্রদান করে। এ বক্তৃতাটি ‘গেটেজবার্গ এড্রেজ’ নামে পরিচিত। আজ সেই বক্তৃতাকে পৃথিবীর সেরা বক্তৃতা বলে মনে করা হয়।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই আমেরিকা বিশে^র নিকট হয়ে উঠে এক বিশাল মানবিক সাহায্যকারী দেশ হিসেবে। বিশে^র দরিদ্র দেশগুলো যাতে দ্রুতগতিতে উন্নতি লাভ করে সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে দেশটি বিভিন্ন সাহায্য প্রদান করে থাকে। অর্থ সাহায্য থেকে আরম্ভ করে খাদ্য সাহায্য পর্যন্ত এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্যে পর্যন্ত সহযোগিতা করে থাকে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে কোন দেশ উক্ত দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে অমনি উক্ত দেশের অর্থ, মানবিক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সহযোগিতাকে কমিয়ে দেয়। এটাকে বিশ^ রাজনীতির একটি অংশ হিসেবে মনে করা হয়। এমনি বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি সুবিধা হয় জিএসপি (জেনেরালাইজড সিষ্টেম অব প্রিফারেন্সেস) সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি’র আওতায় বিশে^র ১২১ উন্নয়নশীল দেশ পণ্য রপ্তানিতে নি¤œ শুল্কসুবিধা পায়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর জিএসপি সুবিধা তুলে নিয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ভারত অন্যায্য আচরণ করছে- এমন অভিযোগ তুলে দেশটিকে দেওয়া বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা জেনেরালাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ হলো যে, ভারত সরকার ওয়াশিংটনকে এমন নিশ্চয়তা দেয়নি যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোকে ভারতের বাজারে ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রবেশাধিকার দেবে। ভারতের ৮ হাজার কোটি ডলার রপ্তানির মধ্যে ৫৬০ কোটি ডলারের পণ্যে এ সুবিধা পায়। সাম্প্রতিক ভারতের ই-কমার্স বাণিজ্য নিয়ে ওয়াশিংটনের সংগে দিল্লির দূরত্ব তৈরি হয়। ভারতের ই-কমার্স বাণিজ্যে বড় অংকের বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামাজন ও ওয়ালমার্ট। কিন্তু সম্প্রতি নতুন ই-কমার্স নীতি করেছে ভারত। এর ফলে উন্মুক্ত বাজারে আর আগের মতো ব্যবসা করতে পারবে না অ্যামাজন এবং ওয়ালমার্টের ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ফ্লিপকার্ট। এ নীতির ফলে গ্রাহকদের ছাড় দেয়া, পণ্য বিক্রি বা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি সবক্ষেত্রেই বাধা তৈরি হয়েছে। ফলে এ বাজারে আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলো বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হুমকিতে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা অনেক আগেই বাতিল করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সুবিধা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা পূর্বের তুলনায় কমে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি প্রত্যাহার করে নিতে চাওয়ার মধ্যে একটি বিষয় পরিষ্কার, আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর কোন দেশের সঙ্গে একপক্ষীয় বাণিজ্যসুবিধা দিতে চায় না। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একই অবস্থা। বিশ^বাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপির আওতায় থাকা তুরষ্কের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি মনে করে, তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাওয়ায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা এখন আর দেশটির নেই। বাংলাদেশ যদিও জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করেছে তবুও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই কমে আসছে। এ কারণে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তবে একটি সুখময় তথ্য হলো যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর-২০১৮) ৩০৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এতে পূর্বের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৯ শতাংশ।

লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট