চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মৃতিতে অমলিন কর্মযোগী মহান মানুষ ইউসুফ চৌধুরীর সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ

প্রদীপ নন্দী

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ

ব্যক্তিগত ফাইলে চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি.- এর উৎকণ্ঠার ২য় প্রকল্প কল্পলোক ফ্ল্যাট ব্লকের একটি প্রয়োজনীয় কাগজ খুঁজতে গিয়ে হাতের স্পর্শে এল কাগজ ভর্তি বিস্কিট রঙের একটি পুরাতন খাম। খামের উপরের লেখাগুলো অস্পষ্ট হতে চলেছে। খামটি দি পূর্বকোণ লিঃ এর পক্ষ থেকে ১৯৯২ সালের ১ এপ্রিল আমার ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ঞযব ঘধঃরড়হ পত্রিকায় যোগদানের নিয়োগপত্র প্রত্যাহারের নোটিশ। অতীতের স্মৃতি অবলোকনে খামটা খুলে চিঠিটা বের করলাম। চিঠির ভাঁজের অনেক জায়গা ছিঁড়ে যেতে বসেছে। কাগজের রঙটা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। চিঠিটা চোখের সামনে তুলে ধরতেই ভেসে উঠল নিরহঙ্কারী, শান্তিপ্রিয়, স্বল্পভাষী একখানা মুখ। যেমনটি টিভি সিনেমায় চিঠি পাঠের দৃশ্যে চিঠির উপরে লেখকের ছবি দেখানো হয়। ভেসে উঠা সেই মুখটি হল বরেণ্য ব্যক্তিত্ব দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা স্বপ্নদ্রষ্টা শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর। স্মৃতির আঙ্গিনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে অতীতের একখ- চিত্র।
১৯৯১ সালের শেষের দিকে, তারিখটা ঠিক জানা নেই। দি ডেইলী লাইফ পত্রিকা অফিসে মর্নিং শিফটে কাজ করছি। সামনে বার্তা সম্পাদক প্রয়াত মুকুল শর্মা। যিনি শর্মাদা নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। উনার পাশের টেলিফোনটা বেজে উঠল। তিনি রিসিভার তুলে নিলেন। কথা হলা নমস্কার, হু ঠিক আছে। ব্যস এতটুকু। রিসিভার রেখে দিয়ে তিনি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে কি যেন ভাবতে থাকেন। একসময় আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আগামীদিন সকাল ১০টায় উনার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন সকালে উনার বাসায় গেলে বললেন, পূর্বকোণ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান ইউসুফ সাহেব উনার পূর্বকোণ অফিসে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। ইউসুফ সাহেবের চায়ের দাওয়াত, কথাটি শুনে ইউসুফ সাহেব সম্পর্কে ভাবতে থাকি।
মনে পড়ে যায় ইউসুফ চৌধুরী সম্পর্কে প্রচলিত প্রবাহসমূহ। তিনি একজন কর্মযোগী মহান পুরুষ। কর্মের সিঁড়ি বেয়ে তিনি প্রতিপত্তিশালী হয়েছেন। মানুষ নানা বৈধ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে বিত্তশালী হন। তেমন কোন অনৈতিক প্রভাব ইউসুফ সাহেবকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি কর্মকে পুঁজি করে করে শ্রমের মাধ্যমে বিত্তবানের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। প্রবাদ আছে, তিনি একজন শ্রমিকপ্রিয় মানুষ। শ্রমকে তিনি অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা ও শ্রমিককে মূল্যায়ন করতেন। তার ফলস্বরূপ তিনি নানা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে কর্মবিমুখ মানুষকে কর্মমুখী করে তুলেছেন। উনার কাছের লোকদের মুখে শুনতাম ইউসুফ সাহেবের হাতে নাকি জাদু ছিল, তিনি যেখানে স্পর্শ করতেন সেখানে সোনা ফলতো। আরো শোনা যেত, তিনি কোন বর্জনযোগ্য বস্তুর অবমূল্যায়ন করতেন না।, এক টুকরো বাতিলযোগ্য কাগজকেও মূল্যায়ন করতেন। তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গিকে মানুষ নানাভাবে বিশ্লেষণ করলেও তিনি শিখিয়ে গেছেন বর্জ্য দ্রব্যও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর পূর্বে বর্জ্য বস্তুর উপর তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছিলেন, পরবর্তীতে সবখানে তাঁর দর্শনের প্রতিফলন উপলব্ধি করা যায়। মানুষ এখন আর কোন অকেজো বস্তু ফেলে দেয় না। জমা করে রেখে ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দেয়, ফেরিওয়ালা তা অন্যের কাছে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।

ভাবতে ভাবতে পূর্বকোণ অফিসের উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠে পড়ি। অফিসে পৌঁছলে পিয়নের সাথে ইউসুফ সাহেবের অফিসের দিকে যাই। অফিসের দরজায় পা রাখতেই তিনি সৌম্য দৃষ্টিভঙ্গি নিক্ষেপ করে মর্মস্পর্শী সম্ভাষণ জানালেন, শর্মাবাবু ভিতরে আয়ন। শর্মাদা নমস্কার জানিয়ে প্রবেশ করলেন। পিছনে পিছনে আমিও প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করে অবাক হয়ে গেলাম। একজন ১ম শ্রেণির বিত্তশালী ব্যক্তি, যিনি একটি দৈনিক পত্রিকার স্বপ্নদ্রষ্টা তাঁর অফিসকক্ষ কি করে এত সাদামাটা হতে পারে। নেই কোন এসি, নেই কার্পেট, নেই কোন দামী সোফা সেট, নেই তেমন কোন দামী আসবাবপত্র। সাধারণ একটা টেবিলের পেছনের চেয়ারে বসে রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। টেবিলের উপর দু’ সেট টেলিফোন আর বেশ কিছু ফাইলপত্র ছাতা তেমন কোন দামী জিনিস চোখে পড়ল না। টেবিলের সামনে কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে। তাতে বসে পড়লাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ক্যান আছন? এ ফাঁকে পিয়ন চা দিয়ে গেল। আলোচনা শুরু হল। তিনি ডেইলী লাইফের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। শর্মাদা সব জানালেন। সব জানার পর তিনি দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। তিনি একটি ইংরেজি দৈনিক বের করবেন। সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। শর্মাদা মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। অনেক সাংবাদিক কাজ পাবেন। চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটি একটি মঙ্গলজনক কাজ। বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা শুরু হল। ফাঁকে পিয়ন একটি খাম টেবিলের উপর রেখে গেল। ইউসুফ সাহেব মুখ খোলা খাম থেকে চিঠিটা বের করে, পড়ে নিয়ে পাশে রেখে দিলেন। সাবলীল ভাষায় আলোচনা চলতে থাকে। আমি শ্রোতা আর দর্শকের ভূমিকায় থাকলাম। আলোচনার ফাঁকে তিনি ড্রয়ার থেকে ছুরি বের করে খালি খামটা সযতেœ খুলতে শুরু করলেন। মুখে কথা, হাতে কাজ। অবাক দৃষ্টিতে ওনার দিকে চেয়ে থকি। তিনি খামটা খুলে হাতের তালু দিয়ে মসৃণ করে উল্টিয়ে নিলেন। ড্রয়ার থেকে গামের টিউব বের করে খামে গাম আটকিয়ে দেন। তারপর পূর্বের ভাজ বরাবর ভাজ করে ব্যবহারযোগ্য নতুন খাম তৈরি করে নিলেন। অভিভূত হলাম ইউসুফ সাহেবের ধীশক্তি দেখে। কাজের মধ্য দিয়ে ধীর স্থির অবিচল চিত্তে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটুকু চালিয়ে যেতে কোথাও একটুও গতিভঙ্গ দেখলাম না। উপলব্ধি করলাম তাঁকে ঘিরে যে প্রবাদগুলো প্রচলিত আছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

প্রবাদপ্রতীম ইউসুফ সাহেবের এমন কর্মকা-কে মানুষ নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানাভাবে দেখতে পারেন। ক্ষণকালের সাক্ষাতে উনার যে কর্মকা-টুকু দৃষ্টিগোচর হল তা থেকে দুটো শিক্ষা নিতে পারি। একটি হলো, কোন বর্জনযোগ্য বস্তুর বিকল্প ব্যবহার নিয়ে চিন্তা করা। দ্বিতীয়টি মিতব্যয়িতা। জনশ্রুতি আছে ইউসুফ চৌধুরী একজন সোনার মানুষ। বুঝতে পারছি, কেন এ প্রবাদ প্রচলিত। ইউসুফ সাহেব ছিলেন নিজে আচরণ করে অপরকে শিখানোর একজন মহান শিক্ষক। তিনি কথায় নয় কাজে বিশ^াস করতেন। সমাজে তার যথেষ্ট স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন।
আলোচনায় মন দিলাম। ইউসুফ সাহেব পত্রিকার নাম প্রকাশ করলেন। দি ন্যাশন। দি ন্যাশনের একটি নামফলক দীর্ঘদিন যাবত পূর্বকোণ পত্রিকার নামফলকের পাশে স্বমহিমায় প্রচার করে আসছিল। ওদিনের মত আলোচনা শেষে চলে আসি। পরে আরো কয়েকবার উনার সাথে দেখা হয়।

মাসখানেক পর ডাকযোগে নিয়োগপত্র পাঠানো হল। নিয়োগপত্র পাওয়ার সপ্তাহখানিকের মধ্যে আরেকটা চিঠি পেলাম। যে চিঠির মাধ্যমে আমার নিয়োগপত্র প্রত্যাহার করা হল। প্রত্যাহারের কারণ হিসাবে প্রত্যাহার পত্রের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি চিঠি। ঐ চিঠিতে উল্লেখ ছিল সাংবাদিকদের নামে ইস্যুকৃত নিয়োগপত্র দেশের প্রচলিত শ্রম আইনের সাথে সংগতিহীন। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের বাধার মুখে তিনি নিয়োগপত্র প্রত্যাহার করে ন্যাশন পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। গর্ভের সন্তান গর্ভে মৃত্যুবরণ করল। শত মানুষের কর্মসংস্থান অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
প্রবাদপুরুষ কর্মবীর ইউসুফ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত চিঠিখানি দীর্ঘদিন পর আমাকে স্মৃতিচারক করে তুলল। আলোর দিশারী সমাজ সংগঠক বরেণ্য মানুষটিকে বিন¤্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট