চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বাল্যবিয়ের পরিণাম

সাবিনা ইয়াসমিন

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ

বিবাহ সামাজিক বন্ধন গড়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। পৃথিবীর শুরু থেকেই এই রীতি চলে আসছে। সামাজিক সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি হলেও এখানে নারী-পুরুষের একান্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টিও নিহিত থাকে। এই নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমেই মানবজাতির বিস্তার ঘটে থাকে। তবে প্রতিটি বিষয়েরই একটি মাত্রা বা সুনির্দিষ্ট সময় রয়েছে। বিবাহপ্রক্রিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। বিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পুরুষের ২১ বছর এবং নারীর ১৮ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক। অন্যথায় তা দেশের আইনে বাল্যবিবাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে পরিগণিত হবে। বাল্যবিবাহের সংজ্ঞায় বলা হয়ে থাকে, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকারী দুই পক্ষের কোনো পক্ষের বা দুই পক্ষের উভয়েরই অর্থাৎ বর ও কনের মধ্যে বরের অথবা কনের অথবা বর ও কনের উভয়েরই যদি বয়স নির্ধারিত বয়সের কম হয় তাহলে তা একটি বাল্যবিবাহ হিসেবে বিবেচিত হবে।

‘জাগো এবং জাগাও, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’-একটি শ্লোগান দেখে মনের ভেতরে প্রশ্ন জাগলো, সত্যিই কি বাল্যবিবাহ রোধে সমাজ জেগে উঠছে? শহরে বাল্যবিবাহের পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও গ্রামে এই মাত্রা এখনও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আছে। বরং এখনো অনেক সমাজ, পরিবার আছে যারা বাল্যবিবাহের সমর্থনকারী।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের নিরোধ আইন ২০১৭ সালে ২.১ ধারায় প্রণীত হয় যে, বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ বছর পূরণ করেন নাই এমন পুরুষ এবং ১৮ বছর পূরণ করেন নাই এমন নারীদের বিবাহকে বাল্যবিবাহ বলা যায়। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থা এতটাই কুসংস্কৃতিতে বিপর্যস্ত যে একটি মেয়ে যখনই ১২ বছরে পদার্পণ করে, তখনই সে যেন পরিবারের বিশাল বোঝায় পরিণত হতে শুরু করে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়ায়, বিয়ে দিলেই আইবুড়ো মেয়ে নামক মণখানেক বোঝা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায়।
প্রতি বছর ৩৯ লাখ ৩০ হাজার শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যানে সমগ্র দেশে বাল্যবিবাহের পরিমাণ কম দেখা গেলেও কিছু লুকায়িত ভয়াবহ চিত্র সমাজে বিরাজমান। ভালো সম্বন্ধ আসলে মেয়েবিবাহ উপযুক্ত না হলেও জন্মনিবন্ধনের কাজে সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে বয়স বৃদ্ধি করে বিবাহ সম্পন্ন করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা বিয়ে মানেই রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন করা। এটি বাংলাদেশের আইন। সুতরাং আইন মোতাবেক কোনো রেজিস্টার্ড কাজী কখনো ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন না। তাহলে এই বাল্যবিবাহ হচ্ছে কীভাবে? বিয়ে পড়াচ্ছেন কে? অবশ্যই কোনো নামধারী কাজী রেজিস্ট্রি না করেই রাতের অন্ধকারে টাকার লোভে বিয়েগুলো দিচ্ছেন। এতে দেখা যাচ্ছে শরীয়াহ মোতাবেক বিয়েটা হলেও কিন্তু আইন মোতাবেক বিয়েটা হচ্ছে না।

বাল্যবিবাহ রোধে টেলিভিশনে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারণা, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের

গণসচেতনতামূলক পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট বিতরণ করা হলেও দুঃখজনকভাবে সত্য যে আমরা এসব শুধুমাত্র চর্মচোখেই দেখি, মর্মচোখ বা আত্মিক চোখ দিয়ে এসব অনুধাবনের চেষ্টা করি না। আফসোসের সুরে বলতে হচ্ছে, বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারতের পরেই বাংলাদেশের ২য় স্থান। মনে রাখতে হবে নেপোলিয়ানের সেই বিশ্বখ্যাত উক্তিটি- আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দিব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান মোতাবেক দেশের শতকরা ৬৬ ভাগ নারী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত; যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহ।

বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা গড়তে তো হবেই, পাশাপাশি বাল্যবিবাহ আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে এবং আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে যেন কোনো অপরাধী পার পেয়ে যেতে না পারে, প্রয়োজনে আইনটির সংশোধন করতে হবে।
সমাজে বিশেষ করে গ্রামে বাল্যবিবাহের কুফল, আইনের শাস্তি উল্লেখ করে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মসজিদের ইমাম ও ওয়াজ-মাহফিলে বক্তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি নারীর উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকারের বিশেষ পদক্ষেপমূলক কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট