চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টলদরদী কর্মবীর মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী

নেছার আহমদ

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম এক প্রাচীন নগরী, বন্দরশহর ও ঐতিহাসিক স্থান। চট্টগ্রামের ইতিহাস ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বের, কর্মের ও ধর্মের, শাসনের ও বাণিজ্যের, সমভূমি ও নদী উপত্যকার এবং পার্বত্যভূমির ও যবনীর (বৈদেশিক) মানুষের মধ্যে মেলবন্দনের। এর কোথায় কৃতি ও কৃতিজনের অভাব? এখানেও এই কিংবদন্তি ধারা সৃষ্টির শেষ নেই। সেই কৃতী কিংবদন্তির অন্যতম ব্যক্তিত্ব আধুনিক সংবাদপত্রের জনক বলে খ্যাত দৈনিক পূর্বকোণ’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চট্টলদরদী কর্মবীর ইউসুফ চৌধুরী। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি ছিলেন খুবই সাধারণ মানুষ। কাজে এবং চিন্তায়ও ছিলেন খুব গোছানো সুন্দর ও সুবিন্যস্ত। যিনি সফলতার উচ্চশিখরে আসন গেড়ে সম্মান ও সমৃদ্ধি পেয়েছেন, তিনি হলেন আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী।

আধুনিক সংবাদপত্র প্রকাশনার পথিকৃৎ পুরুষ, বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সংগঠক মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী রাউজানের ঢেউয়া হাজী পাড়া গ্রামে ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ্ব দুলামিয়া, মাতা মোসাম্মৎ আজিজা খাতুন। আর্যমৈত্র হাইস্কুলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি ইউসুফ চৌধুরীর এবং ১৯৪৩ এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উপমহাদেশে চল্লিশের দশকে যখন বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব চলছিল তখন পাকিস্তান আন্দোলন মাথাছড়া দিয়ে উঠে। এসময় তিনি এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৪৫-এ তিনি একজন বন্ধুসহ রাউজানের ফকিরহাটে ৬২০ টাকা মূলধন নিয়ে বইয়ের দোকানের ব্যবসা শুরু করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর অপার অনুরাগ থেকেই তিনি বই ব্যবসায় প্রবৃত্ত হন। দু’বছর যাবৎ এ ব্যবসা চালিয়ে আশানুরূপ তেমন সফলতা না পেয়ে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান সমবায় সমিতি সদনের সামনে মাসিক ১৮ টাকা ভাড়ায় একটি ছনের তৈরী দোকান ভাড়া নেন। সেখানে তিনি মাত্র দু’হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে মনোহরী দোকান শুরু করেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি পাকিস্তনের করাচী হতে প্রকাশিত ডন গ্রুপের “ইলস্টেট্রেড উইকলি” নামে একটি পত্রিকার এজেন্সী গ্রহণ করেন। এ এজেন্সীর জন্য তাঁকে এক হাজার টাকা জামানত প্রদান করতে হয়।

এ সময়ে তিনি তাঁর পুরোনো দোকানের সন্নিকটে ‘নিউজ ফ্রন্ট’ নামে নিয়ে একটি দোকান মাসিক ৯ টাকা ভাড়া নেন। এরপর তিনি ঢাকা হতে প্রকাশিত মর্নিং নিউজ ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় এজেন্ট নিযুক্ত হন।
১৯৫১-৫২ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান হতে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ডন এবং পাকিস্তান টাইমাস, গুজরাটি ডন, মিল্লাত প্রভৃতি পত্রিকার এজেন্সী পান। ফলে তাঁর ব্যবসা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এ সময়ে তিনি পার্শ্ববর্তী দোকানটি ভাড়া নিয়ে তাঁর বড় ভাই ইউনুস চৌধুরীর সহায়তায় ব্যবসার পরিধি বিস্তৃত করেন। এরপর তিনি পেংগুইন ও পেনিকাল পেপার ব্যাক বইপত্র আমদানী শুরু করেন। তাঁর এসব বই ও ইংরেজি সংবাদপত্র ম্যাগাজিনের প্রধান ক্রেতা ছিলেন বিদেশীরা।
এক পর্যায়ে তিনি একটি প্রিন্টিং প্রেস (ছাপাখানা) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তিনি ‘সিগনেট’ প্রেস স্থাপন করেন। এ প্রেসের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারী প্রথমে স্থানীয় বাজার হতে সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে আমেরিকা ও পশ্চিম জার্মানী হতে আমদানী করা হয়। প্রেসটি সে সময় এ অঞ্চলে আধুনিক প্রিন্টিং প্রেস হিসেবে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। উপমহাদেশীয় নামকরা দৈনিক ও সাময়িকীর এজেন্সীর পাশাপাশি তিনি নিউজ উহক, রিডার্স ডাইজেস্ট, উইকলি টাইমস প্রভৃতি পত্রিকার এজেন্সী পান। এতে তাঁর পরিচিতির প্রসার ঘটে। এরপর হতে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধু ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া।

১৯৬০ সালে বিদেশ হতে কিছু প্রিন্টিং ও কাটিং মেশিন আমদানী করে ব্যবসার পরিধি বাড়ান। এসময় তিনি প্রকাশনা ব্যবসায়ে ও আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবিপি) হতে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পশ্চিম জার্মানী হতে প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং মেশিনারী আমদানী করেন। ছাপাখানার পাশে আলাদা জমিতে তিনি প্যাকেজিং শিল্প স্থাপন করেন। ১৯৬৭ সালে প্যাকেজিং ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করেন এবং আইডিবিপি হতে বৈদেশিক মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ১৯৬৯ সালে মেশিনারী আমদানী করেন। তিনি কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেডের সাথে তাদের ইমারতের পেছনে ছয় হাজার বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট একটি দালান তৈরী করার জন্য এক লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান করে ভাড়া চুক্তি করেন। এ দালানে তিনি ছাপাখানা ও প্যাকেজিং ইউনিট স্থানান্তর করে নেন। ১৯৬৫ সালে বিপনী বিতানে নিউজ ফ্রন্ট ও পুরানো দোকানটিও স্থানান্তরিত হয়।

১৯৭০ সালে প্যাকেজিং মেশিনারীর শেষ চালান চট্টগ্রাম এসে পৌঁছায়। যন্ত্রপাতি স্থাপিত হওয়ার পরপরই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। সব কিছু তিনি একজন গার্ডের তত্ত্বাবধানে রেখে রাউজানের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। স্বাধীনতার পর ক্ষতিগ্রস্ত সব কিছুই তিনি নিজ উদ্যোগে পুনরায় তৈরী করে নতুনভাবে সবকিছু আরম্ভ করেন। আগেই উল্লেখ করেছি তিনি প্রকাশনা শিল্পেও বিনিয়োগ করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান হতে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি নাটকের বই প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম কলেজের জনৈক অধ্যাপকের লেখা “কবিদা” নামের ১২০ পৃষ্ঠার একটি বই তাঁর প্রকাশনা সংস্থা হতে বের হয়। নাটকের বইটি আদমজী পুরস্কার লাভ করে। অতপর বের করেন আবুল ফজলের “শ্রেষ্ঠ গল্প” উল্লেখযোগ্য এসব বই ছাড়াও অনেক বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। যদিওবা পরে তিনি এটি বন্ধ করে দেন।
১৯৮৪ সালে ইউসুফ চৌধুরী ষোল শহরের বিসিক শিল্প নগরীতে সিগনেট বক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ স্থাপন করেন। অতপর ১৯৮৬ সালের ১০ ফেব্রুযারি চট্টগ্রাম হতে আধুনিক মেশিনে ছাপানো দৃষ্টিনন্দন পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশ করেন। পত্রিকা সংবাদপত্রজগতে নতুন বিপ্লবের সূচনা করে। পত্রিকাটি এতদঅঞ্চলে আধুনিক সমৃদ্ধিশালী পত্রিকা হিসেবে পাঠকদের নিকট ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। পত্রিকাটি ইউসুফ চৌধুরীর কর্মজগতে এক অন্যান্য অধ্যায়ের সূচনা করে।

সংবাদপত্র, প্রকাশনা শিল্প ও বই বাণিজ্যের বাইরে তিনি ছিলেন একজন সফল সংগঠকও। ১৯৯২ সাল হতে তিনি ডেইরী ও পোল্ট্রি শিল্পের আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে গঠন করেন ডেইরী এন্ড পোল্ট্রি ফার্ম এসোসিয়েশন। এ সংগঠনে তিনি আজীবন সভাপতি ছিলেন। গবাদি পশু মেলার তিনি অন্যতম প্রধান উদ্যাক্ত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল পাঠাগারও স্থাপন করেন তিনি।
চট্টগ্রামের উন্নয়নে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। চট্টগ্রাম ভেটেনারি বিশ^বিদ্যালয় তাঁর অনন্য কীর্তি। চট্টগ্রামে ভেটেনারি কলেজ স্থাপন এবং কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর তাঁর ধারাবাহিক আন্দোলনের ফসল। এভাবে নানাক্ষেত্রেই তিনি অনন্য অবদান রেখে গেছেন। কর্মযোগী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন এক বিরল কীর্তিপুরুষ। তাঁর পুরো জীবনটাই আমাদের সবার জন্যে শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়।

লেখক : চট্টলগবেষক, কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট