চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাবার ছায়ায় সুখময় দিনগুলো

প্রফেসর ড. সৈয়দা খুরশিদা বেগম

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০২ পূর্বাহ্ণ

বাবার বাড়িতে সবই আছে আগের মত। নেই আমাদের প্রিয় বাবা। আছে এক অপূরণীয় শূন্যতা, অব্যক্ত এক কষ্ট। দুটি বছর হয়ে গেল বাবা নেই। ২০১৭ এর ১৫ সেপ্টেম্বর বাবা চলে যায় আমাদের ছেড়ে। জানতাম যে বাবাকে একদিন হারাতে হবে। কিন্তু জানতাম না বাবা ছাড়া নিজেদের কতটা অপূর্ণ মনে হতে পারে। বাবার মত অত সুন্দর করে কেউতো আর হাসতে পারে না! বাবার মত মায়া করে কেউতো আর বলতে পারে না ‘আজকে থাকো, যাওয়ার দরকার কি ?’
বাবা নেই। আছে বাবার রেখে যাওয়া ঊজ্জ¦ল স্মৃতিগুলো। কত স্মৃতিই না নাড়া দিয়ে যায় মনের গভীরে! বাবার ছায়ায় দিনগুলো যেন মনে হয় এক স্বপ্ন।

আমরা পরপর চার বোনের জন্ম পরিবারে। বিভিন্ন জনের মুখে শোনা যে প্রতিবারই বাবা মহাখুশী। তখন অতটা স্বচ্ছলতা না থাকলেও প্রতিবারই ধুমধাম করে একইভাবে আকিকা করতো। আত্মীয়-স্বজন কেউ কেউ বিরক্ত, ‘মেয়েই তো! এত খুশীর কি আছে?’। বাবা নাকি হাসতো। বাবা কি আসলেই খুশী ছিল আমাদের নিয়ে? হয়ত ছিল। বিভিন্ন জায়গায় সাথে করে নিয়ে যেত আমাদের। ঝাপসা ভাবে মনে পড়ে ছোট বেলার খুব ভাল লাগার একটি স্মৃতি। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শফি মোটর্স লিমিটেডের বিভিন্ন কাজে ঢাকা যাওয়ার সময় প্রায় সময়ই আমাদেরকে বাবা এয়ারপোর্টে নিয়ে যেত। বাবার সাথে ওখানে ঘুরতাম আনন্দে, অবাক হয়ে দেখতাম হরেকরকম ব্যস্ত মানুষদের। কাজশেষে বিকেলে আসার সময়ে বাবা ঠিকই কোথা থেকে যেন আমাদের জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামা নিয়ে আসতো। আজও পরিস্কার চোখে ভাসে সেই সুন্দর জামাগুলো।
প্রথম ভাই যখন আসল অন্যরকম একটা খুশীর আমেজ চারিদিকে। মনে পড়ে ওইদিন বাবা মেয়েদের নিয়ে শপিং এ চলে গেল। কি কি যেন অনেক কিছুই কিনল সবার জন্য। এরপর বাসায় আসতে শুরু করল বিরাট সাইজের সুন্দর সুন্দর দোলনা, ট্রলি, সাইকেল। সেগুলোতে আমরা সবাই একই সাথে উঠে বসে খেলতাম।

মনে পড়ে সেই ছোট বেলায় প্রতি ঈদের আগে চাঁদ রাতের কথা, রূপকথার রাজকন্যার অনুভূতি মনে নিয়ে বাবার সাথে মার্কেটে গিয়ে ইচ্ছেমত বাজার করা। মনে পড়ে বাবার সাথে খেলা দেখতে বসে বাবার অদ্ভুত নিরপেক্ষতা ও সরলতায় অবাক হওয়া। যে দলই গোল করুক বাবা মহাখুশী, ‘গো-ল!’ বলে চিৎকার। কেউ আউট হলেই খুশী, ‘আ-উ-ট!’। অবশ্য খেলায় বাংলাদেশ থাকলে অন্য কথা। বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার গুরুগম্ভীর উচ্চৈস্বরে বিশ্বের খবরাখবর শুনতে শুনতেই ঘুম ভাঙত আমাদের। বাবা আলহাজ এস এম শফি নিয়মিত তার ছোট্ট রেডিওতে সকালেই জেনে নিত পৃথিবীর কোথায় কি ঘটে চলেছে।
বাবার উৎসাহ অনুপ্রেরণা ছিল জীবনে এক পরম পাওয়া। স্কুলে ফাস্ট/সেকেন্ড হতাম। হঠাৎ ক্লাস এইটে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে গেলাম। বাবার সে কি খুশী! স্কুল থেকে সম্ভবত আমিই প্রথম টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া। সবাই বলল মিষ্টি খাবে। বাবা জানতে চাইল কত মিষ্টি লাগবে। একদিন স্কুলে শুনি বাবা মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাইকে দেয়া হচ্ছে। বিরাট মাঠে হৈ চৈ জটলা। দোতলা থেকে হঠাৎ চোখ আটকে গেল মিষ্টির বড় ঝুড়িতে। এত মিষ্টি! এত খুশী! আমার কারণে! ভবিষ্যতে আরও খুশী করার দায়িত্ববোধ অনুভব করলাম প্রচন্ডভাবে।

যখন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হত বাবার কাছে যেতাম। কারণ ‘বাবার সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে না’। এইচএসসির পর দ্বিধায় ছিলাম কি পড়ব। বাবা যখন বলল ‘কেমিস্ট্রি না অনেক মজার’ আমি আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি। বাবাকে অনেক খুশী করতে পেরেছিলাম অনার্স ও মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। বাবা প্রায়ই আমার গবেষণা কাজ নিয়ে জানতে চাইতো। আমার কাজের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য বাবাকে বলতাম ‘আমার গবেষণা কাজগুলো বিশ্বের সেরা সেরা কেমিস্ট্রি জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে’। বাবা আগ্রহ নিয়ে বলতো ‘তো, এই গবেষণায় মানুষের কি উপকার হবে?’। কখনও জানতে চাইত না আমার কি উপকার হবে এই প্রকাশনায় কিংবা প্রমোশনে সাহায্য করবে কিনা !

বাবার ব্যবসা শুরু ও সম্প্রসারণের কঠিন সময়ে মায়ের ধৈর্য, ত্যাগ, সহনশীলতা ও সমর্থনের ব্যাপারে বাবাকে দেখতাম পুরোপুরি সচেতন। বড় হওয়ার পর থেকেই দেখেছি কোন কারণে মায়ের খেতে দেরি হবে বলে বাবাকে আগে খেয়ে নিতে বললেই বাবা কপট রাগ ও অভিমান দেখাত। আগে নয়, যত দেরিই হোক একই সাথে খাবে। বাবা চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার কারণে মা-কে একবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। পরেরদিন সকালেই পাশের কেবিনে বাবাও ভর্তি হয়ে গেল। দেখেছি বাবার কাছে মায়ের অবস্থান ছিল অনেক বড়।
‘বাবা-মা’ ‘ভাই-বোন’ সবাই বাবার কাছে ছিল আসলেই আপনজন। দাদা চলে গেছেন খুবই কম বয়সে। দেখিনি তাকে। হালকা ভাবে মনে পড়ে দাদীর কথা। দাদী শহরে আসলে কিংবা বাবা শহর থেকে গেলেই দাদীর পাশে বসে খুশীমনে যত্ন করে মূল্যবান, মজার সব খাওয়া দাওয়া দাদীকে নিজ হাতে খাওয়াত- আঙ্গুর, বেদানা, ক্যান ভরা আরো কি যেন। বড় চাচা, মেঝ চাচা ও দুই ফুফু সবার সাথেই দেখতাম বাবার সুন্দর সম্পর্ক।

আমাদের বাসায় বাবা আর মায়ের দিকের সব আত্মীয়-স্বজনদের ছিল স্বতস্ফূর্ত আনাগোনা ও থাকার ব্যবস্থা। মায়ের সাথে তাদের দুর্লভ সুন্দর এক বুঝাপড়া। এর মধ্যে দেখতাম একজন দাদী, বাবার ফুফু’র উপস্থিতি ছিল কিছুটা বেশি। দেখতাম মাসের পর মাস বাবা তাঁকে মায়ের সহযোগিতায় ‘নাইওর’ করাচ্ছে। অনেক দিন পরে, সেই দাদী মারা যাওয়ারও অনেক দিন পরে, একদিন কথা প্রসঙ্গে বাবা ব্যাখ্যা করল কেন ওই দাদীকে বাবা এনে এতদিন রাখত। জানাল কোন কারণে ‘বাবার বাড়ির’ ‘নাইওর’টা ওই দাদীর কম হওয়াতে তার জন্য বাবার এই মমতা।
গল্প করতে পছন্দ করত বাবা। অতীতের কত গল্প করেছে আমাদের সাথে! সুখ-দুঃখের সব ঘটনাই একই ভাবে মিষ্টি মিষ্টি হেসে বলে যেত যেন অনেক মজার কিছু বলছে। অবাক হয়ে খেয়াল করতাম, যথেষ্ট কারণ থাকলেও বাবার কথায় কারও প্রতি কোন ক্ষোভ বা বিদ্বেষের লেশমাত্র নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার মনে হতো যখন বাবা শেষের দিনগুলোতেও কোন ঘটনা, এমনকি ছোট বেলার ঘটনাও তারিখ, কারও নাম, জায়গার নাম, সংখ্যাসহ সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারতো। অনেক প্রখর ছিল বাবার স্মৃতিশক্তি।

এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বাবা ওদিকে কথা বলছে। মনে হয় যেন বাবা ওই রুমে হাটছে। মাঝে মাঝে ফোন করি বাবাকে। ফোন কানে দিয়ে বসে থাকি। শব্দ শুনি শুধু ‘আ-ন-রি-চে-ব-ল’। কিসের আশায় যেন আবারও একদিন করি। আবারও। যদি এমন হতো বাবার গলা শোনা যেতো! বলতাম ‘বা-বা কেমন আছ? কেমন আছ বাবা? আমরা? বাবা ছাড়া কি ভাল থাকা যায়? বাবা তুমি জীবনে আর একটু কম পরিশ্রম করলে, দিনের পর দিন ব্যবসায় কাজে এত সময় দেয়ার জন্য নিজের খাওয়া দাওয়ায় এত অনিয়ম না করলে, তোমার আরাম আয়েশের কথা একটু চিন্তা করলে তোমাকে হয়ত এত আগে চলে যেতে হত না। আমরা এখনও ভাল থাকতে পারতাম তোমাকে নিয়ে। বাবা, কেমন আছ তুমি ?’

খুব ইচ্ছে করে জানতে ‘বাবা কি আমাদের দেখছে!’ ভাবতে ভাল লাগে ‘ভাল আছে নিশ্চয় বাবা’! এত নিরহংকার ও স্বচ্ছ মন, এত সততা ও উদারতা, নিঃস্বার্থ দান, মানুষকে এত সাহায্য সহযোগিতা এসবই নিশ্চয় বাবাকে ভাল রাখবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের বাবাকে বেহেস্তে সুন্দরতম শান্তির জায়গা দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

লেখক : প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট