চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে উত্তরণ

নাওজিশ মাহমুদ

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০১ পূর্বাহ্ণ

মানব ইতিহাসকে তিনটি কালে ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল। প্রায়-ঐতিহাসিক কাল এবং ঐতিহাসিক কাল। কোন লিখিত ইতিহাস নাই, তাই প্রাগৈতিহাসিক কাল। লিখিত বর্ণমালার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে কিন্তু পাঠোদ্ধার হয়নি, তাই প্রায়-ইতিহাসের যুগ। এর পর শুরু হয় ইতিহাসের যুগ। লিখিত ইতিহাসের যুগ। কিন্তু সমাজের উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাচীন যুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত, প্রকৃতি থেকে ফলমূল সংগ্রহ, পশু শিকার এবং মাছ ধরার মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহের কাল। দ্বিতীয়ত, পশুপালন, মাছ চাষের মাধ্যমে প্রাণীজ পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনের কাল, সেখানে কৃষির খাদ্য উৎপাদন হলেও ব্যাপক আকারে ছিল না। তৃতীয়ত, কৃষি উৎপাদনের কাল, যার মাধ্যমে খাদ্যে প্রাণীজ পুষ্টির পাশাপাশি কৃষিজ উৎপাদনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠে। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয় বন্যাবস্থা বা পুরাতন পাথরের যুগ। বর্বরতা বা নতুন পাথরের যুগ এবং সভ্যতার যুগ। বন্যাবস্থা এবং বর্বরতা থেকে সভ্যতায় উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লোহার আবিষ্কার। তার সাথে তামা এবং ব্রোঞ্জ ব্যবহারের উৎকর্ষতায় মানবসভ্যতা এগিয়ে যায়। সমাজও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে। গোত্র ও উপজাতি থেকে জাতিতে রূপান্তর ঘটে। পরিবর্তন ঘটে বন্টন ব্যবস্থায়। যেখানে খাদ্য সীমিত ছিল। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে অস্তিত্ব বজায় রাখতে হতো।

সকলে মিলে প্রকৃতি থেকে খাদ্য ফলমূল সংগহ করতো, প্রাণী শিকার করতো। সকলে মিলে ভাগ করে নিত। পশুপালনের মাধ্যমে যখন খ্যাদ্যের উৎপাদন এবং সংরক্ষণ শুরু হয় তখনই ব্যাক্তি মালিকানা ধারণার বিকাশ ঘটে। দক্ষতার তারতম্য ঘটে। মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য শুরু হয়। গোত্রের আর উপজাতির বাহিরের মানুষকে মেরে ফেলার বদলে দাস বানিয়ে রাখার প্রবণতা সৃষ্টি হয়, যাতে অন্যের শ্রমকে নিজের সম্পদ বৃদ্ধিতে কজে লাগানো যায়। এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের, এক উপজাতির সাথে আরেক উপজাতির লড়াইয়ে এক গোষ্ঠী জিতে আরেক গোষ্ঠী হারে। যারা হেরে যায়, বিজেতার দাস হিসেবে গণ্য হয়। এই দাসদের পশুপালনে এবং উৎপাদনে ব্যবহার করা হতো। পশুর মত বেচাকেনাও চালু হয়ে যায়। যে যত দাসের মালিক, সে তত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। গড়ে উঠে দাসভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। দাস এবং দাসমালিক হয়ে উঠে পরস্পরের বিরোধী দুটি প্রধান শ্রেণি। কৃষি উৎপাদন আয়ত্তে আনার পর ব্যাক্তিমালিকানা বিস্তৃতি লাভ করে। দাসদের বিদ্রোহ এবং জমিকে কেন্দ্র করে উৎপাদনের ক্ষেত্র পরিবর্তনের ফলে দাসব্যবস্থা সংকটে পড়ে। জমির মালিকানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ভূস্বামী এবং ভূমির দাস। দাস মালিকের স্থান দখল করে নেয় ভূস্বামী এবং দাসের বদলে ভূমিদাস। গড়ে উঠে সামন্ত সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজ ব্যবস্থায় ভূমিদাস ও ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভু নামে পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণি গড়ে উঠে। সমাজ দাসব্যবস্থা থেকে সামন্ত সমাজে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের ইতিহাস হলো ইউরোপের ইতিহাস। এটাকে ভিত্তি করে সমাজের ক্ল্যাসিকেল বা চিরায়ত ইতিহাস বিন্যাস করা হয়। ভারতের সামাজিক ইতিহাসে দাস এবং দাসমালিকের অস্তিত্ব থাকলেও তা প্রধান শ্রেণি হিসেবে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে নি। সিন্ধু/হরপ্পা সভ্যতায় দাসভিত্তিক সমাজ ছিল না। সিন্ধুসভ্যতার পরে ঋকবেদের ভিত্তিতে যে বর্ণপ্রথা চালু হয়, তা ছিল দাসব্যবস্থার বিকল্প।

ভারতে যে সিন্ধু/হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার সমাজের ভিত্তি ছিল কৃষি। পশুকে শুধু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার না করে কৃষিকাজেও ব্যবহার করে। পশুর দুধ খাওয়া চালু হয়। এর পর শুরু হয় ঘোড়া ব্যবহার এবং পশু পালনের সমাজ। এসময় ঋকবেদেরও প্রচলন। যার ভিত্তি ছিল পশুপালনভিত্তিক উপজাতীয় সমাজ। এর পর আসে কৃষিসমাজ। কৃষি সমাজে জমির মালিকানার মাধ্যমে একটি মধ্যসত্বভোগী ভূস্বামীর উত্থান হয়, যা ভারতীয় সমাজকে মধ্যযুগীয় সমাজের রূপান্তর করে। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক এটাকে সামন্ত সমাজ বলতে চেয়েছেন। এটাকে পুরাপরি সমান্ত সমাজ বলা যায় না। কারণ এখানে ইউরোপের মত ক্ল্যাসিকেল বা চিরায়ত সামন্ত সমাজের উত্থান হয় নি। ইউরোপে রাজারা সমস্ত ক্ষমতার উৎস থাকলেও সমান্তপ্রভুদের উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হতো। সমান্তপ্রভুদের নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল। যুদ্ধের সময় রাজাকে এই সেনাবহিনী দিয়ে সাহায্য করতে হতো। ফলে একটি ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকতো। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত এবং বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য থাকতো। বিনিময়ে সামন্ত প্রভুরা তাঁর নিজস্ব এলাকায় যা ইচ্ছা করতে পারতেন। ভূমিদাস প্রথার মাধ্যমে বংশানুক্রমে একটি বাঁধাশ্রমিক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ছিল। ভূমিদাসদের এলাকা ত্যাগের অনুমতি ছিল না। কিন্তু ভারতীয় সমাজের বংশানুক্রমে ভুমির সাথে বাঁধা কোন দাস বা শ্রমিক ছিল না। বৈশ্য এবং শূদ্ররা উৎপাদনের প্রধান ভূমিকা রাখলেও শ্রম প্রদানের ব্যাপারে তাঁদের স্বাধীনতা ছিল। শ্রম করলে খাদ্য পেত নতুবা পেত না। তবে পেশা বদলের সুযোগ ছিল না। শূদ্র ও বৈশ্য হিসেবে বংশানুক্রমে থাকতে হতো। শ্রম করবে কি করবে না এই স্বাধীনতা ছিল। ব্রাহ্মণরাই সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতো। ক্ষত্রিয়রা শাসনকার্যে নিয়েজিত ছিল এবং রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত থাকতো। শূদ্র বা কৃষিশ্রমিকের কাজ করা বা না করার স্বাধীনতা ছিল। যা ইউরোপীয় সমাজের ছিল না। অর্থাৎ ইউরোপের সমাজ ছিল বদ্ধসমাজ আর ভারতীয় সমাজ ছিল স্থবির সমাজ।

হর্ষবর্ধনের আমল (৬০৬-৬৪৭ সাল) থেকে প্রাচীন যুগকে মধ্যযুগে উত্তরণের কাল ধরা হয় । প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগে উত্তরণের ভিত্তি ধরা হয় সমাজের বৈশিষ্ট্যে উপর। ভারতের প্রাচীন সমাজের বৈশিষ্ট্য ছিল পশুপালন এবং বর্ণপ্রথা। তবে ইউরোপের মত দাস ব্যবস্থা ছিল না। ভারতে গৃহভৃত্যদের সরাসরি দাস বলা যায় না। কারণ বংশানুক্রমের দাসব্যবস্থা ছিল না। ভারতে যে গৃহভৃত্য ছিল তারা ইউরোপের মত দাস ছিল না। কারণ গৃহভৃত্যদের উৎপাদনে ব্যবহার তেমন একটা হতো না। সামাজিক মর্যাদাও ছিল দাসদের তুলনায় উন্নত। এই গৃহভৃত্যরা শ্রমের বদলে খাওয়াপড়ার নিশ্চয়তা ছিল এবং মুদ্রার মাধ্যমে তাঁদের মজুরী পরিশোধ করা হতো। ইচ্ছা করলে তাঁরা গৃহভৃত্যের কাজ ছেড়ে দিতে পারতো। তবে বংশানুক্রমে দাস থাকলেও তারা ছিল সাম্রাজ্যের একটি ক্ষুদ্রাংশ। বংশানুক্রমে ছিল শূদ্র এবং বৈশ্য যারা উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল। গৃহভৃত্যরা উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল না। উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল শুদ্র, বৈশ্য এবং মুক্ত শ্রমিকেরা। সে সাথে ব্যবসায়ী এবং কারিগররা। এদের রাজকর দিতে হতো সরাসরি। আদায় করতো রাজকর্মচারীরা। ফলে মধ্যসত্বভোগী দাসমালিকের অস্তিÍত্ব ছিল না। রাজকর এবং বিশেষ করে ভারতের বর্হিদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রথার ব্যবহারে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবস্থা বিকশিত হয়। উপজাতীয় সমাজ বা গোত্র থেকে পশুপালন শুরু হয়। পশুপালন সমাজ থেকে কৃষিসমাজ গড়ে উঠে। কৃষিসমাজ গড়ে উঠার পিছনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লোহার আবিষ্কার এবং নানাবিধ ব্যবহার। সে সাথে জমি কর্ষণের সুবিধা অর্জনের পর শুরু হয় ব্যাপক হারে খাদ্য উৎপাদন। প্রাণীজ খাদ্যের পাশাপাশি কৃষিজাত খাদ্য। ভারতে কখনও দ্রব্য বিনিময়ের কোন উদাহরণ পাওয়া যায় না। কারণ গোত্রসমাজে সকলে উৎপাদন করতো সকলে ভাগ করে নিতো। এর পরেই ভারতে মুদ্রা চালু হয়ে যায়। কৃষিসমাজের ভিত্তি হলো জমি। জমির মালিকানাকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে উঠতো।

জনবসতি গ্রাম হিসেবে অভিহিত হয়। গ্রাম সমাজের বিস্তার লাভ করে। মধ্যযুগের ভিত্তি হলো এই গ্রামসমাজ। জমির মালিকানা ছিল রাজার। তিনি কৃষকদের পত্তন দিতেন। কৃষক যিনি স্বল্প জমির পত্তন নিতেন। নিজেই চাষ করেন। অধিক জমির যিনি পত্তন নিতেন তার পক্ষে অন্যের সাহায্য ছাড়া জমিচাষ সম্ভব নয়। তিনি নিজেও শ্রম দিতেন এবং অন্যদের মজুরীর বিনিময়ে সাহায্য নিতেন। আরেকটি ছিল সমাজের উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ যারা দানের মাধ্যমে ভূমির মালিক হতেন। তাদের অধিকাংশই রাজকর দিতেন না। ফলে শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে কাজ করতেন অথবা কৃষকদের নিকট বাৎসরিক হিসেবে ইজরা দিতেন, যা বর্গপ্রথা হিসেবে পরিচিত। রাজকর্মচারী যারা কর আদায় করতেন তারা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে কর না নিয়ে শুধু কৃষক এবং বর্গাদারদের কাছ থেকে আদায় করতেন। এই নিয়ে পরে সমাজে অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজকর্মচরাীদের গ্রামে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হতেন। ফলে রাজকোষে অর্থের ঘাটতি দেখা দেয়। এ ছাড়া মন্দির বা ব্রাহ্মণদের ভূমিদানের প্রক্রিয়ায় বজায় থাকায় জমি থেকে রাজস্ব ঘাটতিতে প্রভাব ফেলে। কারণ দানকৃত জমির উপর রাজস্ব মওকুফ ছিল।
ভারতে পশুপালনভিত্তিক সমাজের সাথে বিকশিত হয়েছিল ব্যবসা বর্হিদেশীয় ব্যবসা। বিশেষ করে রোম সা¤্রাজ্যের মূল অংশের সাথে ব্যবসার অবনতি এবং ইরান ও বাইজেন্টিয়ামের সাথে রেশমবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বাণিজ্যরুটকে কেন্দ্র করে যে সকল নগর গড়ে উঠেছিল তার পতন ঘটে। নগর পতনে ব্যবসার পতন। ব্যবসা থেকে রাজস্ব আহরণের ঘাটতির ফলে সা¤্রাজের শাসকদের আর্থিক ঘাটতি দেখা দেয়। তখন জমির উপর নজর দেয়। জমির উপর আর্থিক চাপের ফলে বিদ্রোহ এবং অসন্তোষ দেখা দেয়। ফলে সামাজিক সংকট দেখা দেয়। এই সংকট থেকে উত্তরণের একটি মাত্র উপায় সমাজ নতুন করে বিন্যাস করা। নতুন বিন্যাসে জমি থেকে রাজস্ব আহরণের স্বার্থে ভূস্বামীদের উত্থান ঘটে। বর্ণপ্রথার পরিবর্তন ঘটে। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ একীভূত হয়। আর একীভূত হয় বৈশ্য এবং শুদ্র। ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রীয়রা ভূস্বামীতে রূপান্তরিত হয় আর বৈশ্য এবং শুদ্ররা কৃষক শ্রমিক, কারিগর এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণিতে পরিণত হয়। এভাবে ভারতীয় সামজ প্রাচীন যুগ থেকে মধ্য যুগে প্রবেশ করে।
বাংলায় পশুপালন সমাজ গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয় না। নদী-নালা জলাশয় এবং সমুদ্রের প্রাধান্যের কারণে মাছের প্রাচুর্য ছিল। সেই সাথে বৃষ্টিপাত ও জলাশয়ের কারণে উদ্ভিদজাত খ্যাদ্য বিশেষ করে শাকশব্জী সহজলভ্য ছিল। উদ্বৃত্ত মাছ সংরক্ষণের জন্য শুটকি প্রচলন হয়। যা প্রচুর রপ্তানী হতো। হরপ্পা ও মহেঞ্জদারতো শুটকি এই অঞ্চল থেকে যেতো বলে ধারণা করা হয়। বাংলার মাছ উৎপাদনে জন্য পুকুরে মাছ চাষের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। পলিমাটি বাহিত উর্বর জমিতে প্রচুর খাদ্য উৎপাদেেনর ফলে সমৃদ্ধ গ্রাম গড়ে উঠে। রাজস্ব আহরণেও বেগ পেতে হয় নি। সমুদ্রবাণিজ্য অব্যাহত থাকায় বর্হিবাণিজ্যের কোন ব্যত্যয় ঘটে নাই। শশাংকের পতনের পর জমিকে কেন্দ্র করে যে সকল ভূস্বামীর উত্থান ঘটে, তারাই এক একটি ছোট ছোট ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয়। টিকে থাকে শত বছর ধরে। বাংলায় মধ্যযুগের সূচনা হয় এই সময় থেকে।

বৃহৎ সা¤্রাজ্য বা বড় রাজ্য গড়ে উঠে নাই। কারণ একদিকে শশাংকের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের ভিত ছিল ব্রাহ্মণ প্রাধান্য বর্ণভিত্তিক সমাজ অপর দিকে নালন্দাকে কেন্দ্র করে যে বৌদ্ধ ধর্মের চেতনা বিকশিত হয়েছিল তার ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছিল।
শতবছর ধরে এই বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের দ্বন্দ্ব, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাল বংশের উত্থান ঘটে। দর্শন চর্চাও এই বৌদ্ধদের উত্থানে সাহায্য করে। চার্বাকসহ অনান্য নাস্তিক দর্শনের প্রভাবে হিন্দু ধর্মের তুলনায় বৌদ্ধ ধর্ম অনেকবেশী গ্রহণীয় হয়ে উঠে। সেই সাথে ভাষার প্রভাবও উপেক্ষণীয় নয়। হিন্দু সংস্কৃত ভাষার বদলে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল সহজবোধ্য বৌদ্ধ প্রাকৃতিক ভাষা, যা পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা উত্থানে সহজ হয়। সারা ভারতে হিন্দু ধর্মের ভিত্তি প্রসারিত হলেও বাংলা অঞ্চল বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে নতুন সা¤্রাজ্য গড়ে উঠার ভিত্তির প্রস্তুতি ঘটে এই সময়। পন্ডিতেরা বা ঐতিহাসিকেরা একে মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতা বললেও এই নিয়ে সংশয় আছে। হয়তো কেন্দ্রীভূত কোন শাসন ছিল না। কিন্তু ছোট ছোট অনেক গুলি সামন্ত রাজা গড়ে উঠেছিল। তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী এবং পতাকাও ছিল। কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রীয় কেউ বৈশ্য বা কেউ শূদ্র, কেউ বৌদ্ধ। ফলে নিজেদের সমজাতীয় সম্পর্ক গড়ে উঠতে সমস্যা হয়। এই সমস্যা থেকে সংঘাত বিচিত্র নয়। এই সংঘাতকেই বড় মাছ ছোট মাছ গিলে খাওয়ার প্রবাদকে মাৎস্যন্যায় বলা হয়েছে। কিন্তু শাসক ও প্রজাদের মধ্যে এই ধরনের কোন সংঘাত এবং সমাজে অরাজকতা ছিল বলে মনে হয় না। শত বছর ধরে একটি কেন্দ্রীয় শাসনের ব্যাতিরেকে একটি অঞ্চল পরিচালিত হওয়া বিস্ময়ের ব্যাপার। তবে জমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এ সকল ভুস্বামী নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য পরস্পরে সংঘাত করলেও কেউ কারো ভূমি অধিকার করে নি। তারাই বর্হিশত্রু থেকে রক্ষা এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই সমঝোতার ভিত্তিতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী গোপালকে রাজা নির্বাচিত করে। পাল বংশের সূচনা হয়।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট