চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পবিত্র আশুরার শিক্ষা

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আজ পবিত্র আশুরা। ইসলামি পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কারণে বিশ্বইতিহাসে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যম-িত। যুগে যুগে সংগঠিত সেসব ঘটনার সাথে মুসলমানদের অস্তিত্বের সম্পর্ক রয়েছে। দিনটি বিশ্বনবীর (স.) প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর আত্মত্যাগের মহিমায়ও মহিমান্বিত ও হৃদয়বিদারক স্মৃতিবিজড়িত। হিজরি ৬১ সালের এ দিনে ফোরাত নদীর তীরে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে, তা সমগ্র মুসলিমজাহানকে শোকে-বেদনায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এই দিনে হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এবং হজরত আলীর (রা.) পরিবারের সতেরোজন শিশুকিশোর যুবকসহ মোট ৭৭ জন মর্দে মুজাহিদ অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথানত না করে সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথে লড়াই করে বীরের মতো কারবালার প্রান্তরে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন। মহররম মাস এলেই কারবালার সেই বেদনাবিধুর স্মৃতি জেগে ওঠে, রক্তক্ষরণ হয় প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে।
কারবালার এই মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনা দিবসটিকে আত্মোৎসর্গ আর ন্যায়-নীতির, সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেতনায় সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। অন্যায়-অনাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে দিনটি। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও অসংখ্য ঘটনার স্মারক দিন এটি। মানবইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে বহু উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া ও ধ্বংস-সৃষ্টির স্মৃতি ধারণ করে আছে এই আশুরা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এই দিনে। এ দিনেই তিনি তা ধ্বংস করবেন। এ দিনেই হযরত আদমের (আ.) সৃষ্টি, জান্নাতে প্রবেশ, পৃথিবীতে প্রেরণ ও আল্লাহতাআলার দরবারে তার তওবা কবুল হয়। এছাড়া আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এদিনে। তাই এটি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এই আশুরা জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের ও জিল্লতের পরিবর্তে নাজাতের মহিমায় ভাস্বর ঐতিহাসিক একটি দিন। বিশেষত কারবালার প্রান্তরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ ও স্বার্থত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে রয়েছে শতাব্দী পরম্পরায়। প্রতি বছরই আশুরা আমাদের এ যুগের ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে শেখায়। প্রয়োজনে বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আদর্শিক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের শিক্ষা দেয়। শিক্ষা দেয় লোভ-লালসা ত্যাগ করে সত্য ও সুন্দরের বিরুদ্ধে সব ধরনের চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হতে।

ন্যায় প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে অসীম সাহসের সঙ্গে আপসহীন লড়াই করে কিভাবে প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দিতে হয়, সে শিক্ষা রয়েছে আশুরার দিনে সংঘটিত কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনায়। এটি সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। লোভ ও হিংসার ব্যাপকতায় আজ বিশ্বের দেশে দেশে মানবতা হয়ে পড়ছে বিপন্ন। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, চেচনিয়াসহ নানা স্থানে আজ সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্তে রক্ত ঝরছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চরম পৈশাচিক কায়দায় পরিচালিত হচ্ছে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ। চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ স্বার্থগত কারণে ন্যাক্কারজনকভাবে মিয়ারমারের এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা মুখে মানবিকবিশ্ব গড়ার কথা বললেও কাজে-কর্মে পাশবিকতার প্রমাণ দিচ্ছে। মুষ্টিমেয় মানুষের লোভের কাছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শান্তিতে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা আজ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে মুসলমানরা আজ নানাভাবে নিগৃহীত। নানা ধরনের ভ্রান্তি ও চক্রান্তের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বাড়ছে।

এ অনাকাক্সিক্ষত চিত্রের অবসান ঘটাতে চাইলে আশুরার এই পবিত্র দিনে মুসলমানদের নতুন করে ত্যাগ ও ঐক্যের শপথ নিতে হবে। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, শোষণের কাছে মাথা নত না করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেন (রা.) অকাতরে জীবন দিয়ে আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা অন্তরে ধারণ করে পথ চলতে হবে। সত্য ও সুন্দরের আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে হবে। তবেই এই পৃথিবী অশুভশক্তির রাহু থেকে মুক্ত হবে। তবেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সত্য ও ন্যায়ের শাসন। প্রতিষ্ঠিত হবে মানবসাম্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাতহীন সৌহার্দ্যময় পরিবেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট