চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কারবালার শিক্ষা

জিয়া হাবীব আহসান

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

শাহাদাতে কারবালা বা পবিত্র আশুরা হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, হক ও বাতিলের পার্থক্য নির্ণয় এবং মূল্যবোধের জয়গানের প্রতীক, এটা আমাদের ঈমানী চেতনার উৎস। হিজরী সালের প্রথম মাস মুহররম। পবিত্র কোরানে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা ও বরকতময় ৪টি সম্মানিত মাসের একটি হচ্ছে মুহররম। মুহররম শব্দের দু’টি অর্থ। একটি হচ্ছে হারাম বা নিষিদ্ধ আর অন্যটি হচ্ছে পবিত্র বা সম্মানিত। মহান আল্লাহ এ মাসেই আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন। এ মাসেই তিনি তার অনেক নবী রাসুলকে অনেক বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত করেছেন। অনেকের তওবা কবুল করেছেন। হিজরী সনের প্রথম মাস এ মুহররমে জাহেলিয়াতের যুগ থেকেই যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ)-কেও আল্লাহ ১০ মুহররমই সৃষ্টি করেছেন। একই তারিখে হযরত আদম (আ)-কে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয় এবং পরবর্তীকালে বিচ্যুতি ও পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ দিনটিতেই আল্লাহতালা আদম (আ) এর তওবা কবুল করেন এবং আরাফাতের ময়দানে মা হাওয়া (আ)-এর সঙ্গে তার মিলন ঘটিয়ে দেন। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম, হযরত মুসা (আ)-এর ‘তাওরাত’ কিতাব প্রাপ্তি, হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও আকাশগমন, পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের সূচনা প্রভৃতি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও ১০ মুহররমেই ঘটেছে। আল্লাহতালা পৃথিবী ধ্বংসও ১০ মুহররম তারিখেই করবেন। আরো অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার স্মারকদিন হচ্ছে দশ মুহররম। যার কারণে অন্য সব নবী (আ) এবং তাদের উম্মতরা ১০ মুহররম রোজা রাখতেন। দিনটি সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন।
মুহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। এর শাব্দিক অর্থ ‘দশ তারিখ’। প্রতি বছর বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান তাদের প্রাণপ্রিয় নবীজীর প্রিয়তম নাতি হযরত ইমাম হোসেইনের (রা) মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনায় হৃদয়ে গভীর ব্যথা অনুভব করেন। এ দিনটি আমাদের জন্য শোকের দিন, শিক্ষা দিন, ত্যাগের দিন। পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, হৃদয়ের ব্যাথা অনুভব হওয়া সত্বেও যে উদ্দেশ্যে ইমাম হোসেইন (রা) শাহাদাত বরণ করেছিলেন তার প্রকৃত ঘটনা ও শিক্ষা আমরা খুব কম মুসলমানই জানি। এ দিনে মুসলমানদের হৃদয় শুধু ভারাক্রান্তই হয়, কিন্তু শাহাদাতের মহৎ উদ্দেশ্য কি বা তা’হতে শিক্ষাগ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি না।

আপাত দৃষ্টিতে সেদিন মনে হয়েছিল ইমাম হোসাইন (রা) পরাজিত হয়েছেন । মূলতঃ সেদিন ইয়াজিদ বিজয়ী হয়েও ধ্বংস হয় এবং ইতিহাসে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে সবার ধিক্কারও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। অন্যদিকে ন্যায়ের আদর্শ ও অন্যায়ের প্রতিরোধযুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন হযরত হোসাইন (রা) কে পনের শত বছর পরেও সত্যাশ্রয়ী মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করে ও অশ্রু ঝরায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ঈমানের ৩টি পর্যায় উল্লেখ করে বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অন্যায় দেখে তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা বন্ধ করে। তা না পারলে মুখে প্রতিবাদ করে আর যদি এ ক্ষমতাও না থাকে সে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। এর পর আর ঈমান নেই”। আর তারই যোগ্য উত্তরসূরি প্রাণপ্রিয় নাতি হযরত ইমাম হোসাইন (রা) ইমানের সর্বোচ্চ স্তর থেকে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করেন। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি ছিল তাকওয়া বা আল্লাহভীতি, আর তা রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে ভরপুর থাকত। এই শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা হযরত মুহাম্মদ (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তাইতো তখন আরবের বুকে গভীর রাতেও মেয়েরা অবলীলায় একাকী চলাফেরা করতে পারতো। গভীর রাতে ক্ষুধার্ত শিশুদের দুঃখিনী মায়ের কষ্ট জানতে পেরে সাথে সাথেই রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই কাঁধে করে খাবারের বস্তা নিয়ে আসতো তার ঘরে। এমনকি আইন ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রপ্রধান নিজ পুত্রকেও শাস্তি দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। রাষ্ট্রপ্রধান কতটুকু কাপড় পেলেন বা নামাজে আসতে দেরী হলো কেন তা জনগণকে প্রয়োজনে কৈফিয়ত দিতে হতো। কারণ তারা জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনগণই সর্বোত্তম ব্যক্তিকে নেতৃত্ব প্রদান করতো। রাষ্ট্র পরিচালিত হতো তাকওয়া এবং ইলমসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে। এতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতার স্থান নেই। অথচ মুসলিমবিশ্ব আজ এ আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে স্বাধীন মতামত প্রকাশের ব্যাপারে জনসাধারণের পূর্ণ অধিকার ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রকে আল্লাহ এবং জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হতো। তাই খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় ‘মজলিসে শুরায়’ (পরামর্শসভা) নোটিশ দিয়েই প্রশ্ন করা যেত এবং জনপ্রতিনিধিকে (খলিফাদের) প্রতিদিন পাঁচ বার নামাজের জামাতে ও সন্তাহে জুমাবার জনগণের মুখোমুখি হতে হত। তাঁরা দেহরক্ষী ছাড়াই হাটেবাজারে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁদের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। বায়তুল মাল ছিল আল্লাহর সম্পদ এবং মুসলমানদের আমানত। আর তাই রাজকার্য পরিচালনার সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিরা পরিশ্রমের বিনিময়ে যে ভাতা নিত তার পরিমাণ এতই স্বল্প ছিল যে তাঁদের শত্রুরাও ঐ পারিশ্রমিককে বেশী বলার সাহস পেতো না। রাষ্ট্রে আইনের শাসন ছিল। কেউ আইনের উর্ধ্বে ছিলেন না। অধিকার ও মর্যাদার দিকে পূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু রাজতন্ত্র পদার্পণের সাথে সাথেই এ সকল নীতি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাই পর্যায়ক্রমে ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রভিত্তিক হওয়ার ফলে অযোগ্য রাষ্ট্রপ্রধানকে খুশি করার জন্য ‘জ্বি হুজুরের’ দল সৃষ্টি হয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুত্রপাত ঘটে। জনগণ রাষ্ট্রের উপর আস্থা হারায়। ক্ষমতার হাতবদল আর অন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া জনগণের আর কিছুই করার থাকে না। এমনতর রাষ্ট্রপরিচালকদের জন্য শাহী দরবার সুরক্ষিত নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সুরক্ষিত প্রাসাদ প্রয়োজন। তারা জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে থাকেন। জনগণের দুঃখ-কষ্ট মর্মবেদনা অনুভবের সুযোগ থাকে না। তখন ন্যায় প্রতিষ্ঠার মানদ- হয়ে যায় দু’টি। একটি শক্তিমানের জন্য আর একটি দুর্বলের জন্য।

সেদিন হযরত ইমাম হোসাইন (রা) তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি চরম পরিণতি জেনেও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে বীরের মতো ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্য ও অনুসারীরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইসলামী নীতিগুলোর সংরক্ষণের জন্য আপোষকামিতা নয় বরং মুমিনকে যদি জীবন দিতে হয়, তাহলে প্রয়োজনে জীবনও দিতে হবে। আজ দেশে রাজনীতি এমনকি ধর্মীয় বিষয়েও অঘোষিত রাজতন্ত্র অনুসৃত। যোগ্যতা বিবেচিত হচ্ছে না, যা ইসলাম বহির্ভূত। আজ ‘মুহররম’ আসলে ইতিহাসের সেই মর্মান্তিক দিনের কথা স্মরণ করে বুক চাপড়িয়ে আমাদের সবাইকে শরবত বা পানি পান করানো হয়। মিলাদ মাহফিল, সেমিনার করি। কিন্ত কারবালার প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করি না। নানা কুসংস্কার ও বিদআত এর মাধ্যমে দিবসটিকে মূল উদ্দেশ্য, লক্ষ্য থেকে ঢেকে রাখি । অথচ ৯-১০ মুহররম ২টি রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য সুন্নাত-এ রাসুল (সা)। আমরা যদি সত্যি সত্যি হযরত মুহাম্মদ (সা)কে ও তার প্রিয় নাতিদের ভালোবেসে থাকি তাহলে কারবালার ঘটনা হতে শিক্ষা গ্রহণ করে ঈমানের দাবী পূরণ করতে হবে। ইসলামের অবস্থান সবসময়ই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। আর ইসলামবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কারবালার প্রধান শিক্ষা।

ইমাম হোসাইনের (রা) আদর্শ হচ্ছে সত্যের জন্যই জীবন, সত্যেই মরণ। একজন ঈমানদার মুসলমানের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে অন্যায়, অবিচার, অসত্যের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অবধি লড়ে যাওয়া। তার কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনেক বেশী। ইমাম হোসাইন (রা) সেই মূল্যবান শিক্ষাটিই দিয়ে গেছেন সমগ্র মানবজাতিকে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লড়াকুদের কাছে তিনি যুগ পরম্পরায় প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। আমাদের সবার উচিত ইমাম হোসাইনের শিক্ষাকে ধারণ করে ভারসাম্যপূর্ণ একটি পরিশুদ্ধ, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বিশ্ব গড়ার আন্দোলনে সামিল হওয়া। সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, অপশাসন, শোষণ-বঞ্চনা প্রভৃতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেরও এক অনুপম প্রেরণার উৎস ইমাম হোসাইনের (রা) শাহাদাত। এ শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে একটি নিরাপদ, শাস্তিময় ও সমৃদ্ধ সমাজ, দেশ ও বিশ্ব গড়া কঠিন হবে না। ঈমানের দাবী হলো জীবন দিয়ে হলেও অন্যায়ের মূলোৎপাটন ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। এক বিখ্যাত উর্দু কবি বলেছেন, “ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ।” অর্থাৎ হোসাইনের শাহাদাতে লুকিয়ে ছিল এজিদের মরণ, “নবজীবন পায় ইসলাম প্রতি কারবালার পরে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’লা আমাদের সকলকে কারবালার সেই মর্মান্তিক ঘটনা হতে শিক্ষা লাভ করে কুরআনের নির্দেশ ও মহানবী (সা) কে অনুসরণের মাধ্যমে সত্যিকারের মুসলমান হিসাবে জীবন যাপন করার তৌফিক দিন। আশুরা বা কারবালার শিক্ষা হোক আমাদের জন্য অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় চলার পথের পাথেয়।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট