চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিরঞ্জীব মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের মনীষাদীপ্ত প্রবাদপুরুষ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে নশ্বর জগতে জীবনের সব উজ্জ্বল অর্জন সমর্পণ করে তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। সশরীরে তিনি আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত নেই। কিন্তু তাঁর তেজোদীপ্ত জীবনসংগ্রাম ও সাধনার আলেখ্য অনির্বাণ আলোক শিখার ন্যায় দেদীপ্যমান হয়ে আছে। এ অঞ্চলের সেরা পাঠকপ্রিয় দৈনিক পূর্বকোণ তাঁর অমর কীর্তি। যাদের মেধা ও মননের স্পর্শে রচিত হয়েছে এদেশের সংবাদপত্র জগতের উজ্জ্বলতম অধ্যায়, তিনি নিঃসন্দেহে তাঁদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। জনগণের আকাক্সক্ষার আলোকে একটি আধুনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনার পাশাপাশি চট্টগ্রামের উন্নয়ন-আন্দোলনে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে এ অঞ্চলের জনগণের জন্য তিনি দিয়ে গেছেন আলোকিত এক পথরেখা। সে পথ ধরেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। তিনি আজো চট্টগ্রামবাসীর কা-ারী হয়ে জনহৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে আসীন। তাঁর আদর্শ ও শিক্ষা আমাদের প্রতিনিয়ত দিক-নির্দেশনা দিয়ে চলেছে। অনন্তকাল ধরেই জনমানুষের হৃদয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে।

সংবাদপত্র যে দেশ ও জনসেবার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, তা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই সূচনালগ্ন থেকেই তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে সত্যিকার অর্থে জনগণের মুখপত্র হিসেবে, দেশ ও জনস্বার্থের প্রহরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টায় তিনি পুরোপুরি সফল হয়েছেন। আজো পূর্বকোণ জনমানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে তাঁর দেখানো পথ ধরে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী কেবল শুধু ব্যক্তিসত্তাই নয়, একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যে প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নপূরণে, ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিল। তিনি চট্টগ্রামের অধিকারবঞ্চিত মানুষের মনে সঞ্চারিত করেছেন সাহস, তেজ ও সংগ্রামী চেতনা। দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নবঞ্চিত চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার আদায়ের অহিংস সংগ্রামে নিরাপোষ-নির্ভীক ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নে দাবিতে আয়োজিত সব আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সাহস যুগিয়েছেন। ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি’র প্রধান হিসেবে তিনি যখনই আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন, তখনই বঞ্চনার বেড়াজাল ছিন্ন করতে মাঠে নেমেছেন এ জনপদের অধিকারবঞ্চিত মানুষ। সাধারণ মানুষকে অধিকারসচেতন করে তুলতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পূর্বকোণ যে অকুতোভয় ভূমিকা পালন করেছে তারও কোন জুড়ি মেলা ভার। তিনি সবসময় চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামবাসীর ন্যায্য স্বার্থ ও অধিকারকে প্রাধান্য দিতেন বলেই জনগণ তাঁকে ‘চট্টলবন্ধু’ সম্বোধন করতেন। তাঁর অন্যতম স্মরণীয় একটি কীর্তি হলো চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। তৎকালের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এটি সিলেটে প্রতিষ্ঠার সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। এ অবস্থায় ইউসুফ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠার যুক্তিপূর্ণ কারণ তুলে ধরে জনমত তৈরীর মাধ্যমে সরকার প্রধানের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। পাশাপাশি দাবি পূরণের লক্ষে চট্টগ্রামবাসীকে নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করেন। শেষ পর্যন্ত সরকার এই যৌক্তিক দাবি দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামেই স্থাপিত হয়। বিশ^বিদ্যালয়টি আজ দেশের কৃষি ও পশুসম্পদকে বিকশিত করার পাশাপাশি কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে গুণগত পরিবর্তন সাধন করে জনমানুষের দারিদ্রমুক্তির পথে বিপ্লবের সূচনা করেছে। ওষুধশিল্পের বিকাশেও তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি ‘ইউনাইটেড ক্যামিকেলস’ নামের স্বনামধন্য ওষুধ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে দেশে ওষুদের চাহিদা মিটাতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এখনো প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় ওষুধশিল্পে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখে চলেছে।
বাংলাদেশের ডেইরি আন্দোলনেরও অগ্রপুরুষ ছিলেন তিনি। দেশে ডেইরি শিল্পের বিকাশে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। তিনি আমৃত্যু ডেইরি ও পোলট্রি ফার্ম এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। ডেইরি শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার ব্যাপারে সরকারসহ সবার দৃষ্টি কাড়তে তিনি চট্টগ্রামে প্রথম গবাদিপশু মেলার আয়োজন করেন। দেশে প্রথম তাঁর নেতৃত্বে রুগ্ন গরু নিয়ে মিছিল হয়। আজ দেশ গবাদিপশু ও দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হয়েছে। এর ভিত্তি নির্মাণে ইউসুফ চৌধুরীর অবদান ছিল অসামান্য। তিনি ডেইরি শিল্পের বিকাশের পথকে মসৃণ করতে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে দাবি পেশের পাশাপাশি এই শিল্পকে জনঘনিষ্ঠ করতে কাজ করেছেন।

বঞ্চিত চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্যে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, অনিয়ম-দুর্নীতি, সন্ত্রাসী পেশীশক্তির অরাজকতার বিরুদ্ধেও সোচ্চারকণ্ঠ ছিলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাখো জনতা সন্ত্রাসবিরোধী মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন। জনতার অহিংস শক্তির ব্যবহার করে তিনি প্রশাসনকে বাধ্য করেছিলেন অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে। জনগণকে সাথে নিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশবান্ধব চট্টগ্রাম গড়ার আন্দোলনেরও সূচনা করেছিলেন তিনি। দৃশ্যদূষণ প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে শুরু করে জলাবদ্ধতা, জনপথের দুর্দশা থেকে যানজটের স্থবিরতা, পাহাড়কাটা এবং পরিবেশদূষণ থেকে নগরউন্নয়ন, সুস্থ ও নিরাপদ জনজীবনের সব বিষয়ে ফলপ্রসূ প্রতিকার পেতে এখনও দৈনিক পূর্বকোণ তাঁর প্রদর্শিত পথই অনুসরণ করে চলেছে। একজন দেশব্রতী মানুষ হিসেবে ইউসুফ চৌধুরী আরো নানাভাবে জনগণের হিতসাধন করে গেছেন। দেশকল্যাণে জীবনসংগ্রামী এই সাহসী কর্মবীরের অবদান অশেষ।

মহাপ্রাণ মানুষ ও জ্ঞানঋদ্ধ সংগঠক ইউসুফ চৌধুরী সোনার চামচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন নি। কিন্তু সততা, চেষ্টা ও সাধনার বলে তিনি নিজেকে সফলতার এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা অন্য সবার জন্যে, বিশেষত নতুন প্রজন্মের জন্যে শিক্ষার ও প্রেরণার। আজকের প্রজন্মের জন্য এ জীবন অনুসরণীয়। বাস্তবিকপক্ষেই তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। তিনি জনমানুষের মনের মণিকোঠায় দেদীপ্যমান, তিনি চিরঞ্জীব। আজকের এই দিনে আমরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং প্রার্থনা করি, আল্লাহতায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট