চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফুটপাতেই পথচারীর প্রাণ নিল ঘাতক বাস সড়কে নৈরাজ্য রুখবে কে?

৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে সড়কনৈরাজ্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আরেকবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কর্মজীবী নারী ফারহানা নাজ’র মর্মান্তিক মৃত্যু। ফুটপাতের মতো নিরাপদ স্থানেই তাকে পিষে মারলো ঘাতক বাস। এর আগে গত ২৭ আগস্ট কৃষ্ণা রায় নামে আরেক নারী কর্মজীবীকেও ফুটপাতেই গুরুতর আহত করে ঘাতক বাস। বাংলামটর এলাকায় নিজের অফিসের উল্টো পাশের সড়কের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ওই সময়ে বেপরোয়া গতির একটি বাস ফুটপাতে উঠে ধাক্কা দেয় তাকে। উদ্ধার করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। দুই দফা অস্ত্রোপচারে বাঁ পা ঊরু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয় তার। ওই মর্মন্তুদ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার বেপরোয়া গতির আরেক বাসের চাপায় ফুটপাতেই প্রাণ গেল কর্মজীবী নারী ফারহানা নাজ’র। এ ঘটনা স্পষ্ট করেছে এখন ফুটপাতও নিরাপদ নয়। বেপরোয়া গতির ঘাতক বাস ফুটপাতেও হানা দিয়ে প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। এটি খুবই উদ্বেগকর।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি-আমতলীর মাঝামাঝি মহাখালী উড়াল সড়কের পাশে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠছিলেন ফারজানা নাজ। ঠিক তখনই দ্রুতগতিতে আসছিল ঘাতক বাসটি। বেপরোয়া গতির বাসটি প্রথমে ধাক্কা দেয় বিদ্যুতের একটি খুঁটিতে। সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে দাঁড়ানো থাকা এক যুবক ছিটকে পড়ে যান। কিন্তু বাসের গতির কাছে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সময় পাননি ফারহানা নাজ। ফুটপাত ঘেঁষে বাসটি মুহূর্তেই মুচড়ে দেয় আরেকটি সড়কবাতির খুঁটি। বাসের ধাক্কায় বেঁকে যায় খুঁটি। পাশে থাকা ফারহানা নাজ পড়ে যান সড়কের ওপর। তাঁর মাথা ফেটে ঝরতে থাকে রক্ত। পরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু তখন আর দেহে প্রাণ ছিল না ফারহানার। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। একইদিন বেপরোয়া গতির অন্য একটি বাসের চাপায় প্রাণ হারিয়েছেন কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদের ছোট ভাই সংগীত পরিচালক পারভেজ রবসহ আরো অনেকে। এভাবে সড়কদুর্ঘটনায় প্রতিদিনই একের পর এক প্রাণ ঝরছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে এতো আন্দোলন-সংগ্রামের পরও কেনো এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু এড়ানো যাচ্ছে না, কেনো থামানো যাচ্ছে না বেপরোয়া চালকদের, তা বোধগম্য নয়।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে সড়কদুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন অনেকটাই মহামারী আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। প্রতিকার উদ্যোগ জোরালো না হওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে। বিভিন্ন তদন্ত ও গবেষণারিপোর্ট বলছে সড়কদুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে প্রথম কারণটি হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো। প্রায় ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের বেপরোয়া গতি ও চালকের স্বৈরাচারী মনোভাব। পাশাপাশি বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাট নির্মাণে ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোনের ব্যবহার, চালকদের মাদক সেবনসহ নানা কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আবার যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতাও অনেক দুর্ঘটনার কারণ। তবে আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে, একইসঙ্গে সাধারণ মানুষ সচেতন ও সোচ্চাার হলে এই চিত্রের অবসান হতো। উল্লেখ্য, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত বছরের আগস্টে আন্দোলনে নেমেছিল। তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়কপরিবহন আইন পাস করে, যাতে দুর্ঘটনায় শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর সড়কদুর্ঘটনা রোধ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কমিটি ৯টি সিদ্ধান্ত ও ২০ দফা সুপারিশ করেছিল। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সড়কদুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বর্তমানের অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আইন, নির্দেশনা কোনো কিছুরই সঠিক বাস্তবায়ন নেই। ফলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু এভাবে দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থা চলতে পারে না।

আমরা মনে করি, এ বিষয়ে আর খামখেয়ালির সুযোগ নেই। সরকারের উচিত এমন আয়োজন নিশ্চিত করা যাতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই কমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্যে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণসমূহের দিকে নজর দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার। মনে রাখা দরকার, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে হলে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবার মানোন্নয়নের বিকল্প নাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট