চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সিডনীতে রোহিঙ্গা ও বাঙালি সমাচার

মোহাম্মদ খালেদ বিন চৌধুরী

৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

রোহি ঙ্গা সমাচার : সিডনী তথা অস্ট্রে লিয়াতে রোহি ঙ্গাদের আগ মনের ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ৯০ এর দশকে তাঁরা প্রথম নৌপথে অবৈধ ভাবে অস্ট্রেলিয়া আসতে শুরু করেন। আরাকানে রোহিঙ্গাদের উপর বর্মী সেনাবাহিনীর নিপীড়ন শুরু হলে এরা যেমন বাংলাদেশে পাড়ি দেয়, তেমনি অনেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যায়। তারপর মালয়েশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া। সেখান থেকে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে একইভাবে অস্ট্রেলিয়া। এই নৌ পথে যাত্রা এত সহজ নয়। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ আর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টমাস দ্বীপ এর মধ্যে এ পথ। তারপর দালাল এর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এর ফিশিং বোট-এ করে মূল ভূখ-ে প্রবেশ করে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়। দিনের পর দিন সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে যারা শেল্টার সেন্টার এ জায়গা পায়, তারা ভাগ্যবান। কারণ একবার শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় মানে অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ। একটি নির্দিষ্ট সময় পার হলে এদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু, কোনভাবেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে মায়ানমার-এ ফেরত পাঠানো হয় না। মানবাধিকার এর ছায়া তলে আশ্রয় পেয়ে স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা পেয়ে যায়।

প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গা হয় স্থায়ী বা অস্থায়ী প্রোটেকশন ভিসা নিয়ে ২০-৩০ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া বসবাস করছে। এদের অনেকের এখনও অস্ট্রেলিয়া ইমিগ্রেসন ডিপার্টমেন্ট-এর প্রোটেকশন ইন্টার্ভিউ এসেসমেনট হয়নি। ফলে তারা অনেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আসতে পারছে না। না পারছে স্পন্সর ভিসা-এর মাধ্যমে তাদেরকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে । ২০১৮ সালে প্রায় ২০ জন জাল ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে আসতে চাইলে ঢাকা এয়ারপোর্ট-এ আটক করা হয় ও আবার ফিরতি বিমানে অস্ট্রেলিয়া ফেরত পাঠানো হয়। সিডনী ও এডিলেইড-এ সক্রিয় একটি গ্যাং এই জাল ভিসা তৈরিতে নিয়োজিত। এদিকে অস্ট্রেলিয়া সরকার চাচ্ছে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠাতে। সম্প্রতি সরকার ফেরত যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদেরকে ২৫ হাজার ডলার অফার করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া বসবাসরত রোহিঙ্গাদের প্রথম প্রজন্ম অশিক্ষিত হলেও দ্বিতীয় প্রজন্মরে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে তেমন না গেলেও হাই স্কুল পর্যন্ত পড়াশুনা করছেন। রোহিঙ্গারা ফ্যাক্টরিতে অপারেটর, নির্মাণশ্রমিক, বুচার, প্লাম্বার এর কাজ করেন। ল্যেকেম্বা শহরে কয়েকজন দোকান এর মালিক রয়েছেন। ল্যাকেম্বা তে একজন ধনী ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁর দোকানটি ওখানে সবচেয়ে বড় গ্রোসারি শপ। শুনেছি তাঁর কাছে রোহিঙ্গারা টাকা জমা রাখেন। আর তিনি মুনাফা দিয়ে তাদের সেই টাকা তাঁর ব্যবসাতে খাটান।
আমাদের দোকানে একজন রোহিঙ্গা বুচার হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর কাছ থেকে শুনলাম, তিনি কিভাবে প্রথমে মায়ানমার থেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া আসেন। তাঁর বয়স যখন ২২ বছর, তখন বর্মী সেনাবাহিনী একদিন তাঁর বাড়িতে হানা দেয় ও বেয়নেট দিয়ে মাথায় খোঁচা দেয় । তিনি কোন রকমে মাথা সরিয়ে নিলে বেয়নেট তাঁর কপালে লাগে ও এর পর পালিয়ে গিয়ে বন-জঙ্গল-এ কিছুদিন থেকে নৌকায় করে প্রথমে মালয়েশিয়া চলে আসেন। ওখানে কয়েক বছর কাটিয়ে ইন্দোনেশিয়া ঢুকেন। ইন্দোনেশিয়া অনেকদিন থেকে এক ইন্দোনেশীয় মেয়েকে বিয়ে করেন। যদিও মায়ানমার-এ তাঁর প্রথম স্ত্রী সন্তান রয়েছে। এই ইন্দোনেশীয় স্ত্রীর ঘরে তাঁর এক মেয়ে জন্ম গ্রহণ করল। সেই ইন্দোনেশীয় মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে ছয় বছর আগে জাভা দ্বীপ হয়ে মূল অস্ট্রেলিয়া ভু খ-ে ঢুকলেন। তারপর স্ব-পরিবারে কিছুদিন শরণার্থী কেন্দ্রে কাটিয়ে এখন স্বাধীন জীবন যাপন করছেন। তবে নির্দিষ্ট সময় পরপর অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্র্যাসন এন্ড বর্ডার ডিপার্টমেন্ট-এ রিপোর্ট করতে হয়। তার মত অনেক রোহিঙ্গা এর কাছে এই জীবন মায়ানমার এর নির্যাতিত জীবনের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও স্বস্তির ।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মায়ানমার সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু করে, তখন দেখলাম, তারা কিভাবে সেই সিডনী শহরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল ও এর বিরুদ্ধে সব অস্ট্রেলীয় বাসীর মধ্যে জনমত গড়ে তুলেছিল। তারা মানববন্ধন আয়োজন করে, চাঁদা তুলে নিজ কমিউনিটির পক্ষে কাজ করছিল। লেবানিজ কমুনিটিসহ সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ও বয়ানে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সবাই বক্তব্য রাখছিল। অনেক রোহিঙ্গা অবশ্য সে জন্য কৃতজ্ঞতা ও প্রকাশ করেছিল।

বাঙ্গালি সমাচার :
অনেক উচ্চ শিক্ষিত বাংলাদেশী দীর্ঘ দিন ধরে অস্ট্রেলিয়াতে রয়েছেন। অনেক কৃষিবিদ, ডাক্তার, আই টি ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, একাউন্টেন্ট রয়েছেন যারা সেখানে ভালভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু, কিছু হতাশা ব্যঞ্জক চিত্রও রয়েছে। এরশাদ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ থেকে হাজারখানেক সরকারি চাকুরিরত কৃষিবিদ স্কিলড মাইগ্রেসন প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন। এই প্রোগ্রাম এর আওতায় তারা বিভিন্ন কৃষিকেন্দ্রে ও ফার্ম-এ কৃষিবিদ হিসেবে কাজ করার চুক্তি ছিল। কিন্তু, সেই প্রোগ্রাম-এ যাওয়া একজন কৃষিবিদ আমাকে বললেন, প্রায় ৮০ ভাগ কৃষিবিদ সেই কাজে যোগ না দিয়ে বা পরে ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন অড জব করা শুরু করলেন। যেমন, ট্যাক্সি ক্যাব চালানো, রেস্টুরেন্ট-এ কাজ। কারণ, কৃষি-খামার ও সেন্টার গুলো শহর থেকে অনেক দূরে, অর্থাৎ রিমোট এলাকায় অবস্থিত। একজন ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে পাশ করে স্কিলড মাইগ্রেসন নিয়ে গিয়ে বিডিএস ডাক্তার ট্যাক্সি চালালেন পুরোটা জীবন। এখন তাঁর বয়স ৬৫ এবং তিনি একজন বেনেফিট-ভোগী। তার সঞ্চয়ও তেমন নাই। অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের বা অন্যান্য দেশ থেকে যেসব ডাক্তার যান, তারা চাইলেই ডাক্তারি করতে পারেননা। তাদের কিছু প্রফেসনাল পড়াশুনা বা কোর্স ইত্যাদি করতে হয় । সেই কষ্ট অনেকেই করতে চান না বলে অড জবেই ঢুকতে হয়। আর শুনলাম, স্কিলড মাইগ্রেসন প্রোগ্রাম এর আওতায় বাংলাদেশে সরকারি চাকুরি করা এমবিবিএস ডাক্তার মাইগ্রেশন করে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কয়েক মাস থেকে ফিরে এসে আবার সরকারি চাকুরিতে জয়েন করেছেন। দেশের আরাম আয়েশের সরকারি ডাক্তারের চাকুরি ছেড়ে তিনি বিদেশের মাটিতে অড জব করতে চান নি। কিন্তু, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসনাল কোর্স করে এখন ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার এর কাজ করছেন।

বাংলাদেশি ভাই-বোনেরা অনেক পরিশ্রম করছেন, দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। যারা পরিবার ছেড়ে থাকছেন, তারা তো অনেক কষ্ট করছেন। আবার যারা পরিবার নিয়ে ওখানে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন, তারাও কষ্ট করছেন। তাদের কাছে সান্তনার ব্যাপার এই যে তাদের পরিবার তাদের সাথে রয়েছে। তাদের সন্তানেরা নিরাপদ ভবিষ্যৎ উপভোগ করবেন। দেশে তারা কোন অড জব করতে না চাইলেও বিদেশের মাটিতে যে কোন কাজ ই করতে সংকোচ করছেন না। সেখানে করতে পারছেন কারণ, সেসব দেশে ছোট-বড় সব কাজের মর্যাদা রয়েছে । সে জন্য দেখা যায়, সুইডেন, ডেনমার্ক এসব দেশে স্বামী হয়ত প্লাম্বার এর কাজ করছেন, আর স্ত্রী ইউনিভারসিটি তে শিক্ষক। ব্যাংক এর ম্যানেজার এর পাশের ফ্ল্যাট-এ ক্লিনার এর ফ্ল্যাট ।
দীর্ঘ ৯ মাস সিডনীতে থেকে ২০১৭ এর নভেম্বর-এ বাংলাদেশে ফিরে আসি। এই সময়ে সিডনী শহরের জীবন- যাত্রা, দর্শনীয় স্থান, কসমোপলিটান নাগরিক জীবন এ সব আমাকে অনেক অভিজ্ঞতা জুগিয়েছে। ভ্রমণ আমাকে সব সময় আনন্দ দেয়। জীবনে নতুন উপলব্দি যোগ করে। জীবনের অচেনা অলিগলি নতুন আলোতে উদ্ভাসিত করে। শুধু আমি নই, আমার স্ত্রী, সন্তানেরা উন্নত, সভ্য সমাজের সংস্পর্শে এসে, বিশেষ করে আমার সন্তানেরা বিভিন্ন জাতির ছেলেমেয়েদের সাথে পড়াশুনা করা ও মিশবার ফলে তাদের মনোজগতের যে পরিবর্তন হয়েছে, এবং তাদের জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতার ভা-ার সমৃদ্ধ হয়েছে, সেটিই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় অর্জন ।

লেখক : প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, বি জি সি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট