চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুখী জীবন

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

স্কুলজীবনে বাংলাসাহিত্যে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটির নাম ছিল ‘সুখ না দুঃখ’। এ গল্পের লেখক ছিলেন প্রমথ চৌধুরী (যতটুকু মনে পড়ে)। গল্পের আরম্ভটা ছিল এ রকম- “মাছিমারা কেরানী’ নিয়ে আমরা যতই ঠাট্টা রসিকতা করি না কেন, আসলে মাছি ধরা যে কতবড় শক্ত কাজ তা সকল ব্যক্তিই জানে।” এ গল্পের সারমর্ম হলো যে, দিনরাত মানুষ পরিশ্রম করে সুখী হওয়ার জন্য। কেউ সুখী হতে চায় অধিক অর্থ উপার্জন করে। কেউ সুখী হতে চায় একজনকে ভালবেসে। কেউ সুখী হতে চায় পুত্র সন্তানের জনক হয়ে। আর কেউ সুখী হতে চায় কন্যা সন্তানের জনক হয়ে। কিন্তু উপরোক্ত ব্যক্তিদের যদি প্রশ্ন করা হয়- পাওয়ার পর তাঁরা সুখী কিনা? আমার অভিজ্ঞতা বলে- প্রত্যেকে উত্তর দিবে তাঁরা সুখী নয়।

সুখ বা শান্তি নামক বস্তুটিকে ধরার জন্য মানুষ দিন-রাত পরিশ্রম করে। কেউ কেউ মনে করে, অধিক অর্থ প্রাপ্তিতে সুখ। কিন্তু ধনী ব্যক্তিদের যদি প্রশ্ন করা হয় তারা সুখী কিনা, তবে দেখা যায় তারাও সুখী নয়। আবার দরিদ্র ব্যক্তিদের যদি প্রশ্ন করা হয়, তারাও বলে যে অর্থ অভাবে তাঁরাও সুখী নয়। কারণ অর্থ না থাকার কারণে পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু তারা ক্রয় করতে পারে না। অর্থ অভাবে সন্তানদের ভাত ও ভাল জামাকাপড় দিতে পারে না। সন্তানদের ভাল স্কুলে পড়াতে পারে না। উৎসবে অধিক অর্থ ব্যয় করতে পারে না। অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তিদের বক্তব্যে একটি কথা ফুটে উঠে যে, যেহেতু অর্থ অভাবে এসব কাজ করতে পারে না, সেহেতু পর্যাপ্ত অর্থ পেলেই তারা সুখী হবে বলে মনে করে। কিন্তু প্রেমে পাগল কোন যুবক বা যুবতীকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে কিসে তাঁরা সুখী হবে? এতে দুইজনেরই উত্তর হবে অর্থ প্রাপ্তিতে তারা সুখী নয়। বরং দুইজন পরস্পরকে কাছাকাছি পাওয়াতে তারা হবে সুখী। অতএব সুখের বা শান্তির সংজ্ঞা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। সুখ নামক বস্তুটির নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না।

এক এক জনের নিকট সুখের সংজ্ঞা এক এক রকম। আবার সুখ কখনো চিরস্থায়ী নয়। এর উত্থান ও পতন আছে। অতিসম্প্রতি এশিয়া অঞ্চলের একটি দেশের রাজা এক বিদেশী সুন্দরীকে বিয়ে করার জন্য রাজসিংহাসন ত্যাগ করেছেন। অবশ্য তাঁদের একটি সন্তান জন্মগ্রহণের পরে যখন জানা যায় উক্ত সুন্দরীর সাথে তাঁর নিজ দেশে অপর পুরুষের সম্পর্ক ছিল এবং তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে যখন প্রকাশ পায় তখন সিংহাসন হারানো রাজা সুন্দরী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে। এ ঘটনার অর্থ এরূপ যে, রাজা তার পূর্বের স্ত্রীকে ত্যাগ করে পরদেশি সুন্দরীকে বিয়ে করে সুখী হতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে পরদেশি সন্দুরীর পূর্বইতিহাস যখন জানা হয়ে গেল তখন রাজা আর সুখী হতে পারেনি। অর্থাৎ সুখ জিনিসটি স্থায়ী কোন বস্তু না।

কেউ কেউ মনে করেন, অর্থনৈতিক ক্রমউন্নয়ন ব্যক্তির সুখ বা শান্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। কোন দেশে দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হলে সেই দেশে সুখ তথা শান্তির বাতাস বহে অধিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়। দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্যের সংখ্যা হ্রাস পায়। জনগণ নিজ নিজ প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে। অধিক ক্যালোরী গ্রহণ করতে পারে। সন্তানদের যথাযথ শিক্ষাদান করতে পারে। সমাজ তথা ব্যক্তির আর্থিক ক্ষমতায় উন্নয়ন ঘটে বেশি। এতে পরিবারের মধ্যে তথা সমাজে শান্তি তথা সুখ ফিরে আসে। এদিক থেকে বলা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সুখ বা শান্তির সম্পর্ক আছে। এ সম্পর্ক সাধারণত ধনাত্বক। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি যতই বৃদ্ধি পায় সুখের গতিও তত বৃদ্ধি পায়।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস (আইইপি) প্রতি বৎসর বিশে^র ১৬৩টি দেশের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, শান্তির সূচক ব্যবহার করে দেশগুলোকে সাজানো। বিশেষ করে আর্থিক ও মানসিক বিষয়গুলোকে স্থান দেয়া হয় অধিক। তাছাড়া সামাজিক সম্পর্ক যা মানুষকে প্রশান্তি প্রদান করে তাকেও বিবেচনায় আনা হয়। ২০১৯ সালে সকল সূচককে ব্যবহার করে অধিকতর শান্তি ও সুখী দেশের একটি তালিকা উক্ত গবেষণা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। এবারের সূচকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে আইসল্যান্ড। এরপরে আছে নিউজিল্যান্ড, পুর্তগাল, অস্ট্র্রিয়া, ডেনমার্ক, কানাডা, সিঙ্গাপুর, স্লোভেনিয়া, জাপান ও চেকপ্রজাতন্ত্র। আর শান্তির সূচকে সবচেয়ে নীচের অবস্থানে আছে আফগানিস্তান। সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দশ দেশের বাকি ৯টি হলো- সিরিয়া, দক্ষিন সুদান, ইয়েমেন, ইরাক, সোমালিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, লিবিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এবং রাশিয়া। বৈশি^ক শান্তির সূচকে (জিপিআই) এবার ৮ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশে^র ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০১ তম। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৩ তম। অর্থাৎ শান্তি সূচকে ৮ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও ভূটান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে এবার শীর্ষে অবস্থান করছে ভূটান। শান্তি সূচকে তাদের অবস্থান ১৫তম। জিপিআই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৈশি^কভাবে সীমিত আকারে শান্তি বেড়েছে। আলোচ্য দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর সহিংসতা কী ধরণের প্রভাব ফেলেছে তা সূচক গনণায় বিবেচনা করা হয়েছে। ২০১৮ সালে সংঘাত-সহিংসতার কারণে বিশ^ অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অংক বিশে^র মোট উৎপাদনের ১১.২ শতাংশ। সূচকে বিশে^র ৮৬টি দেশের উন্নতি হলেও ৭৬টি দেশের অবনতি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশসহ ৯টি দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে এ দেশের এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের ১৬ শতাংশ ভূমি হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন আগামী দিনে বিশ^শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। উষ্ণায়নের কারণে বিশে^র প্রায় ১০০ কোটি মানুষের জীবন উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। এরই মধ্যে তাদের ৪০ শতাংশ লড়াই ও সংঘাতে জড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একইসাথে সুখ তথা বিশ^শান্তি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। দেশের মানুষ স্থিতিশীল অবস্থা থেকে যখনই বাস্তুচ্যুত হয় তখনই শান্তির সূচকে স্থান হ্রাস পায়। যদিও সুখ একটি মানসিক ব্যাপার, তবুও বলা যায় তা অনেকাংশে নির্ভর করে আর্থিক স্বচ্ছলতার ওপর। অবশ্য আর্থিক স্বচ্ছলতার পরও মানুষ সুখী নাও হতে পারে, যদি পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয়
সংঘাত বিদ্যমান থাকে।

লেখক : ট্রেজারার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট