চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কারবালার শিক্ষা

জসীম উদ্দীন মাহমুদ

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ

মুহাররম মাসের দশম তারিখ ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে অভিহিত। প্রাচীন কালের নানা জনগোষ্ঠীর নিকট ‘আশুরা’ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। ইহুদীদের নিকট ‘আশুরা’ জাতীয় মুক্তিদিবস হিসেবে পরিচিত। ‘আশুরা’র মর্যাদা ইসলামেও স্বীকৃত। মুসলমানগণ রোযা পালনের মাধ্যমে ‘আশুরা’র মাহাত্ম্য স্মরণ করে থাকে। আশুরা’র দিনে পৃথিবীর বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়। আসমান-জমিন, আরশ-কুরসী সৃষ্টি, ধরাপৃষ্ঠে প্রথম বারিবর্ষণ, আদিপিতা হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, হযরত নূহ (আ.) এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদী পাহাড়ে অবতরণ, ফিরআউনের নির্যাতন থেকে হযরত মূসা (আ.) কর্তৃক ইহুদীদের উদ্ধার, দূরারোগ্য ব্যাধি হতে হযরত আইয়ূব (আ.)-এর সুস্থতা লাভ, মৎস্যউদর হতে হযরত ইউনূস (আ.)-এর নির্গমণ, হযরত সুলাইমান (আ.)-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রদান, নমরুদের অগ্নিকু- হতে হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর নিস্কৃতি, হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর চক্ষুজ্যোতি পুনঃপ্রাপ্তি, কূপ হতে হযরত ইউসূফ (আ.)-কে উদ্ধার, হযরত ইদরিস (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উত্তোলন, কারবালায় হযরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত বিপুল ঐতিহাসিক ঘটনার নিরব সাক্ষী ‘আশুরা’।

মদিনায় হিযরতের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) লক্ষ্য করেন যে, ইহুদীরা ‘আশুরা’ দিবসে রোযা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোযা রেখেছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে মুক্তি প্রদান করেছিলেন, ফেরাউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হযরত মূসা (আ.) কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এদিন রোজা রাখেন, এ জন্য আমরাও রোজা রাখি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন।” (সহীহ মুসলিম, ১/৩৫৯। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “রমযানের পর সব রোজার (নফল) মধ্যে আশুরা’র রোজা সর্বশ্রেষ্ঠ।” (জামে তিরমিযী ১/১৫৬। পবিত্র আশুরার দিন রোজা রাখার ফযিলত সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, “আমি আশা করি যে ব্যক্তি ‘আশুরা’ দিবসে রোজা রাখবে তার এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা (ক্ষমা) হয়ে যাবে।” (মুসলিম ১/৩৬৭)। আশুরার দিনে রোজা রাখলে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দেন (মুসনাদে আহমদ)।

৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর (৬০ হিজরীর ১০ মুহাররম) কারবালা প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রা.) মর্মান্তিক শাহাদাত ‘আশুরা’-কে তাৎপর্যমন্ডিত করে। খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জীবন ছিল হযরত হোসাইন (রা.)-এর মূল লক্ষ্য। মুসলিমজাহানের বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। হযরত হোসাইন (রা.)-এর গৃহীত পদক্ষেপ ছিল বিরত্বপূর্ণ। মদীনার পরিবর্তে দামেস্কে রাজধানী স্থানান্তর, উমাইয়াদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ, কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা সর্বোপরি ইহুদী আব্দল্লাহ ইবনে সাবা’র ষড়যন্ত্র কারবালা হত্যাকা-ে জন্ম দেয়। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হযরত হোসাইন (রা.) স্ত্রী, পুত্র, বোন ও ঘনিষ্ট ২০০ অনুচর সহকারে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছলে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ তাঁকে বাধা প্রদান করে। রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে ইমাম হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন, প্রথমত তাঁকে মদীনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক নতুবা দ্বিতীয়ত, তুর্কী সীমান্তের দূর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, তৃতীয়ত, অথবা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেস্কে প্রেরণ করা হোক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। হযরত হোসাইন ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, “সংলাপের এ অনুরোধ যদি মেনে নেয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতো।” (বিষষ যবফ রঃ নববহ ভড়ৎ ঃযব টসধুুধফ যড়ঁংব, রভ ঃযব ঢ়ৎধুবৎ যধফ নববহ ধমৎববফ ঃড়.)।

অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। হযরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির হাহাকার ওঠে। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি এমনকি নিছক ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্যও নয়; খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার কাম্য। ১০ মুহাররম ইয়াজিদ বাহিনী তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংঘটিত এ অসম যুদ্ধে একমাত্র পুত্র ইমাম জায়নুল আবেদীন ব্যতীত ৭০ জন পুরুষ শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান; অবশেষে শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্ষা ফলকে বিদ্ধ করে দামিস্কে প্রেরিত হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যার্পন করলে কারবালায় পবিত্র দেহসহ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ইতিহাসবিদ গীবন বলেন, “সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে হযরত হোসাইনের শাহাদাতের শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে সমবেদনার সঞ্চার করবে।”(ওহ ধ ফরংঃধহঃ ধমব ধহফ পষরসধঃব ঃযব ঃৎধমরপ ংপবহব ড়ভ ঃযব ফবধঃয ড়ভ ঐঁংধুহ রিষষ ধধিশবহ ঃযব ংুসঢ়ধঃযু ড়ভ ঃযব পড়ষফবংঃ ৎবধফবৎ.)। ইতিহাস সাাক্ষী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে করুণপন্থায়। ইয়াজিদ বাহিনী

কর্তৃক পবিত্র মক্কানগরীর কা’বাগৃহ অবরোধকালীন ইয়াজিদের মৃত্য ঘটে।
‘আশুরা’-এর শিক্ষা বহুমাত্রিক : ১. অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত না করা ২. আলোচনা ও সংলাপের সুযোগ আসলে তা গ্রহণ করা ৩. জালিম ও ঘাতকের বিচার পৃথিবীতে হয়ে যায়, বাকী থাকে কেবল পরকালীন বিচার ৪. স্বৈরাচারীর পতন অনিবার্য। কারবালা যুদ্ধে জয়লাভ ইয়াজিদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল পরাজয়ের নামান্তর। এ বিয়োগান্তুক ঘটনা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, পারস্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় এবং সর্বোপরি ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য সমূহবিপর্যয় ডেকে আনে। কারবালার শোকাবহ হত্যাকান্ড মুসলিম বিশ্বের শিহরণ জাগিয়ে তোলে। ইমাম হোসাইন অন্যায় ও অসাধুতার সাথে আপোষ করেননি। তাঁর এ শাহাদাত গৌরবোজ্জ্বল আদর্শরূপে পরিগণিত হয়। তাই মুসলমানদের আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করে। শোকের সাগর হতে অফুরান শক্তিতে পুনরায় জিন্দা হয় ইসলাম। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহার এ শাশ্বত সত্য কথাটিকেই চিরন্তন মহিমায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায় নি¤েœাক্ত দুটি চরণে;
“কত্লে হোসাইন আসলে মে মর্গে এজিদ থা
ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবারালাকে বাদ।”
অর্থাৎ হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মাঝে আসলে এজিদের অপমৃত্যুই নিহিত ছিল; কেননা প্রতিটি কারবালার পরেই ইসলাম পুনর্জীবন লাভ করে।
মুসলিম জাহানের নিকট ঐতিহ্যম-িত ‘আশুরা’র দিবসে অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করতে চেয়েছে, পবিত্রতাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। কিন্তু পাষাণ হৃদয় সীমারের কঞ্জর হযরত হোসাইন (রা.)-এর শিরচ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্বকে, মহানুভবতাকে এবং পবিত্র ধ্যান-ধারণাকে হত্যা করতে পারেনি। কারবালার নৃশংস হত্যাকা-, রাজ্যলোভী ইয়াজিদের উন্মত্ততার পর শত শত বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু দশই মুহাররম বা আশুরা আসে তেমনি তরতাজা শোকের মাতমে, মর্মবিদারকে, হাহাকারে, অন্যায়কারীর প্রতি তীব্রতম ধিক্কার বহন করে। ন্যায়ের জন্য ত্যাগ এমন কি জীবন বিসর্জন দেয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্ত হিসেবে। পবিত্র ‘আশুরা’ সকল মানুষের নিকট অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য হবে অনাগত যুগ যুগান্তর ধরে। দশই মুহাররম চিরকাল নির্যাতিত মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে যদি বিশ্বের মুসলমানদের দিকে তাকাই তবে এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ১০ মুহাররম আমরা বিভিন্নভাবে শোক পালন করলেও আমাদের জীবনে কেউ কারবালার আদর্শ গ্রহণ করছি না। কারবালায় বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় নাতী হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আমরা ন্যায়, সত্য ও খেলাফত তথা সাম্যনীতি থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছি। ফলে সারাবিশ্বের মুসলমানদের জীবনে নানাভাবে নেমে এসেছে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও সীমাহীন জিল্লতী; অথচ কারবালার রক্তাক্ত ময়দানে মুসলিম উম্মাহ্র মুক্তিবাণী ঘোষণ করে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) বলেছেন,
পৃথিবী তার রূপ পরিবর্তন করেছে, তার গতি ফিরেছে, সত্যের সাথে মিথ্যার লড়াই জোরদার হয়েছে। জীবন অতি জঘন্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিভীষিকা চতুর্দিক বেষ্টন করেছে। হায় আফসোস! তোমরা দেখছ না যে, সত্য পদদলিত হচ্ছে; প্রকাশ্যে অন্যায় আচরণ ছড়িয়ে পড়েছে, একে বাধা দেবার মত কি কেউই নেই? সত্যের জন্য মোমিনের একমাত্র আল্লাহর নিকট আশ্রয় গ্রহণ ও সাহায্য চাওয়া উচিত। তাতেই রয়েছে মুক্তি।
“আমি শহীদী মৃত্যুই কামনা করি; জালিমের সঙ্গে বেঁচে থাকাও পাপ।”
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সত্য উপলব্ধি এবং মিথ্যা পরিহার করার তৌফিক দিন। আমীন।

লেখক : ইসলামি গবেষক, কথাসাহিত্যিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট