চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

আমার মামা সাংবাদিক আতাউল হাকিম

ডেইজী মউদুদ

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

সাংবাদিক আতাউল হাকিমকে চেনেন না চট্টগ্রামে এমন মানুষ বিরল। তিনি আমার মামা । আমরা তাঁকে মেজোমামা ডাকতাম। তাঁর ডাক নাম ছিল রাজু। সম্ভবত: দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর ছিলেন বিধায় তার এই নাম দেয়া হয়েছিল। একবারে যখন ছোট ছিলাম, তিনি আমাকে ডেইজী না ডেকে ডাকতেন ‘জেঠী ’ বলে। আমাকে বলতেন জেঠী, আমার জেঠা কোথায়? আর আমার নাকি উত্তর ছিল ‘জেঠা ধান কাটতে গেছে। তখন আমি বুঝতাম না কেন তিনি আমায় এভাবে ডাকতেন, অনেক পরে বুঝেছি এটি ছিল তার সহজাত রসিকতার সম্বোধন। উনার সাথে আমার রয়েছে অজ¯্র স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা বলি।
আমি সম্ভবত ক্লাস এইট কিংবা নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে আমার রেনু খালা (দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক খালেদ সাহেবের স্ত্রী) দেওয়ানবাজারস্থ বাসা আমেনা মঞ্জিলে বেড়াতে আসি। আতাউল হাকিম সাহেব সেই বাড়িতে থাকতেন। তিনি তখন সাংবাদিকতা করছেন দৈনিক আজাদীতে। একদিন সন্ধ্যায় আমাকে আর শামীম আপা (খালেদ সাহেবের মেয়ে) কে বলেন, সন্ধ্যায় তোমরা রেডি থাকবে, গাড়ি আসবে তোমাদেরকে একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবো। তো উনার কথামতো আমরা তৈরি হয়ে রইলাম। জাস্ট টাইমে গাড়ি আসলো। আমি আর আপা গেলাম উনার সাথে। নগরীর সুন্দর একটি হলের সামনে নামলাম। অনেকটা সিনেমা হলের মতো। আমাদের একবারে সামনের সিটে (ভিআইপি) বসালেন। তিনি কোথায় বসলেন মনে নেই। লাইট নিভে গেল। চোখের সামনে থেকে আস্তে আস্তে পর্দা সরে যেতে লাগলো। কি অপূর্ব লাইটিং, সবুজ, গোলাপি লাল নীল রোশনাইয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। মঞ্চে আসলেন মাইক্রোফোন হাতে নায়িকা কবরী আর সুচরিতা। একজন পরেছেন গোলাপী ঝকমকে কাতান শাড়ি আরেকজনের পরনে নীল বর্ণের কাতান শাড়ি। জীবনে চাক্ষুষ নায়িকাদের দেখলাম খুব কাছে থেকে। তখন এত সুবিধা ছিলনা, না হলে স্বপ্নের নায়িকাদের তখনই আলোকচিত্রের ফ্রেমে বন্দী করতাম। সেদিন চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিলাম শুধু উনার কারণে।

আরো আগে ১৯৭০ সালে আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে একবারে ছোট ক্লাসে পড়ি। আমার আপার বিয়ে হবে। উনাদের বাড়ির উঠোনে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করে স্টেজ বানানো হয় বরের জন্য। উনি তখন চট্টগ্রাম কলেজে অনার্স পড়ার পাশাপাশি আজাদীতে চাকরি করছেন। আমাদের হবু বর চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক (প্রফেসর ড. শামসুল আলম)। বরযাত্রী আসবেন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকেরা। বিয়ে উপলক্ষে মানপত্র ছাপা হলো। সেই সাথে একটি ব্যঙ্গাত্মক ও রসঘন কথামালা ছাপা হলো। এটি সম্ভবত আমার মামা আতাউল হাকিম সাহেব লিখেছিলেন। এটি বিয়ের আসরে পাঠ করার জন্য আমাকে সিলেক্ট করা হলো। শুদ্ধ পাঠ করার জন্য রিহার্সেল চলে সপ্তাহব্যাপী। আমি পাঠ করলাম যথারীতি।

তবে কি একটা শব্দ ভুল করে ফেলেছিলাম, তা বুঝলাম যখন আসরে সবাই হো হো করে হেসে উঠে মজা করছিলেন। আমার

এখনো মনে আছে, ড. জয়নাব আপা, ড. হাসনা বেগম আপা তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছিলেন।
এর পরের ইতিহাস অন্যরকম। আমি ১৯৮৬ সালে পূর্বকোণের সূচনালগ্নে যখন সাংবাদিকতায় যোগ দিই, কিছুদিন পর তিনিও যোগ দিলেন পূর্বকোণে। ফলে দীর্ঘদিন সহকর্মী হিসাবে তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ পাই। তিনি ডেস্ক-এ শিফট ইন চার্জ ছিলেন। পাতায় কি পরিমাণ নিউজ লাগবে তা খুব বুঝতেন। একটি নিউজ কমও হতোনা, আবার বেশিও হতোনা। হিসাবটা যেন দাঁড়িপাল্লার মতো। আমি খুব অবাক হতাম। রসিক মানুষ হিসাবে তিনি সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। আমাদের নন্দী দা’কে বলতেন, ‘নন্দী, কোন দি যাইবেন, ইনদি না উনদি।’ আবার শিশিরদা’ কিছুদিন সাহিত্য পাতার পাশাপাশি রমণীয় পাতা দেখতেন। তখন তিনি শিশির দা’কে ডাকতেন শিশির আপা বলে। চলাফেরা খানা-দানায় তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন এবং দিলদরিয়া। আমার মেয়েকে কখনো নাম ধরে ডাকেন নি। ডেকেছেন গার্ল ফ্রেন্ড বলে। কিছুদিন আগে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে মেয়ের সাথে জামাইকে দেখে বলেন, দেখি বলো তো কে বেশি সুন্দর, আমি না তোমার জামাই্, আমার মেয়ে বলেন ভাইয়া আপনিই বেশি সুন্দর। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকে উনাকে পূর্বকোণের ভাইয়া বলে ডাকতেন। আমার ছেলে একটু কৃষ্ণবর্ণ বিধায় তাকে ডাকতেন বারাক ওবামা বলে। পূর্বকোণে থাকাকালে তিনি প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি একবার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে আমেরিকা যান। অফিসের প্রত্যেকের জন্য ছোটখাট টোকেন গিফট আনেন। আমার জন্য স্পেশাল গিফট আনেন, একটি তিন লহর মুক্তার মালা। আর মেয়ের জন্য চুলের ক্ল্পি, হেয়ার বেন্ড আর চকোলেট আনেন। এই ধরণের অজ¯্র স্মৃতি আজ আমার মানসপটে জ¦লজ¦ল করছে। গত কয়েক মাসে তিনি বেশি ফোন করতেন রায়হানের জন্য মেয়ে দেখতে। ছেলের বউ দেখার জন্য এক পর্যায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এবং যেদিন মেয়ে ঠিক হলো আমাকে ফোন করেন। দেখলাম কি প্রফুল্ল, মহাখুশি তিনি। আমায় দিনক্ষণ জানিয়ে দেন। খুব সুন্দর করে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো।

আমার সাথে উনার শেষ দেখা হয়, রাউজানে উনার ছোটবোন নাসরীন খালার মৃত্যুতে। দেখি বিষণœ বদনে বারান্দায় বসে আছেন। কিন্তু, চিরাচরিত নিয়মমাফিক সেদিনও বেশভুষায় টিপটপ। সেদিন বুঝিনি মাত্র কয়েকদিন পরেই তিনিও বোনের সহযাত্রী হবেন। আজ তাঁর শূন্যতা আমাদের পীড়া দিচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একের পর এক নানা রকম স্মৃতি। মাথার উপরের নক্ষত্রগুলো কিভাবে খসে পড়ছে একে একে। আমাদের রাজু মামা, আমার মেয়ের পূর্বকোণের ভাইয়া, আপনি যেখানে থাকুন ভালো থাকুন। মহান সৃষ্টিকর্তা আপনাকে যেন রাখেন পরম শান্তিতে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট