চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শাহাদাতে কারবালার ধর্মীয় গুরুত্ব ও শিক্ষা

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

আলাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, যুগে যুগে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য তার প্রিয় বান্দাদের থেকে সত্যের সাক্ষ্য নিবেন। অর্থাৎ তার অনেক প্রিয় বান্দাকে শহীদের মর্যাদা দিবেন। তাদের মধ্যে অনেক সাহাবী সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আর অনেকে সত্যের সাক্ষ্য দানের জন্য সাহসী মন ও শাহাদাতের তামান্না নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কারবালার মরু প্রান্তরে মহান নবী পরিবারের উত্তরসুরী হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.)ও তার পরিবারবর্গের অবিস্মরনীয় আত্মত্যাগ ছিল সে ধরনের কলোত্তীর্ণ সত্যের সাক্ষ্য ।

মূলত: কারবালা ছিল এক অসম যুদ্ধ। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধের আয়োজন ও হতাহতের যে পরিসংখ্যান থাকে, কারবালা যুদ্ধ সে তুলনায় অতি নগণ্য। যেমনি ক্ষণস্থায়ী তেমনি হতাহতের সংখ্যাও কম, তদুপরি আয়োজনও ছিল মাথাভারী। একপক্ষে সশস্ত্র যোদ্ধা ৬ হাজারের মত, অপরপক্ষে নিরস্ত্র মানুষ শ’খানেকেরও কম। এরপরও এ’টি ইতিহাস প্রবলভাবে আঁকড়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। এর কারণ একদিকে ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা ও যুদ্ধনীতি লংঘনের দৃষ্টান্ত, অপরদিকে দ্বীনে হকের প্রতি অবিচল নবী পরিবারের সদস্যদের শাহাদাত গ্রহণের পুত তামান্না।
তাই কারবালা নিছক যুদ্ধ ও সংঘাত নয়। নবী ইব্রাহীম (আ.) যেমন পুত্র কুরবানী দানের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে খোদা – প্রেমের নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তেমনি নবীজীর (স.) দৌহিত্র, মহাবীর আলীর পুত্র ফাতিমার কলিজার টুকরো ইমাম হুসাইন (রাদি.) নিজেকে এবং ভক্ত-অনুরক্তদের কারবালায় কুরবানী দিয়ে অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেনঃ অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার, কোন ভয়-ভীতি কিম্বা লোভ-লালসার মুখেও সত্য, আদর্শ থেকে পিছ-পা না হওয়ার। এখানেই কারবালা সার্বজনীন ও সার্বকালীন গুরুত্ব পেয়েছে।

আমরা সকলে জানি, মুহরমের আশুরা বিশ্ব ইতিহাসে অসংখ্য ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী। ঠিক একইভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখবো, ৬১ হিজরীতে সংঘটিত মর্মন্তুদ কারবালার ঘটনাও পরবর্তী ইসলামী দুনিয়ার দেদার উত্থান পতনের দৃশ্য ও বিপ্লব প্রতিবিপ্লবের উৎসমূল। পরবর্তী মুসলিম ইতিহাস ও শাসনপ্রণালীতে এর প্রভাব রয়েছে সুদূরপ্রসারী। কারণ, যুগে যুগে রয়েছে স্বার্থান্ধ মিথ্যুক ও প্রতারক শ্রেণীর পদচারণা, মুখোশধারীদের দৌরাত্ম্য আর এদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য, সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্দাদিল মু’মিন মানুষদের আবির্ভাব ও সাহসী সংগ্রাম। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যুগসন্ধিক্ষণে এ সংস্কার ও সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসেবে মূর্ত হয়ে উঠেছে বারেবারে হুসাইনের আদর্শ ও আহলে বাইতের শাহাদাত। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, নবীবংশের সেদিনের আত্মদানের বদৌলতেই আজো আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কর্তৃক আনীত ইসলামের অবিকৃত ধারা ধরাধামে দিন দিন প্রসারিত হয়ে জগতবাসীর প্রভূত কল্যাণ সাধন করে যাচ্ছে। কারবালার যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পরিবারের মহিলা সদস্যদের অবদানও ছিল প্রচুর।

উলেখ্য, দীর্ঘ ২৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে হযরত মুহাম্মদ (স.) ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতঃ মদীনা রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। তাঁর তিরোধানের পর তাঁর মহান চার খলীফা রাষ্ট্র ও ধর্মীয় দায়িত্বভার আঞ্জাম দেন।
ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় এ দায়িত্ব পালনকে ‘খিলাফত’(বা প্রতিনিধিত্ব) বলে। এ খিলাফতের পুত ও গুরু দায়িত্ব জনগণের মতামত তথা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরামর্শক্রমে কোন যোগ্যতর ব্যক্তির উপর অর্পিত হয়ে থাকে। এ পদের যোগ্যতা বিবেচনায় প্রয়োজন হয়ে পড়ে নিষ্কলুষ চরিত্র, বিশাল ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় ও পার্থিব জ্ঞানে পান্ডিত্য।

আমীরে মুয়াবিয়ার পর চতুর্থ খলীফা হযরত আলীর (রাদি.) দ্বিতীয় পুত্র জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে এ – পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুয়াবিয়া স্বেচ্ছাচারিতা করে নিজ অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে এ- পদে অধিষ্ঠিত করেন। উপরন্তু, ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেই ইসলাম অসমর্থিত কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে খিলাফতের মর্যাদা ক্ষুণœ করলে মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিরাগভাজন হন। ইমাম হুসাইন (রাদি.) অধিকাংশ শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে ইয়াজিদের অবৈধ ক্ষমতা দখল ও এর যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

কুফাবাসীর আমন্ত্রণে তিনি কুফা রওয়ানা হলে পথিমধ্যে কারবালা নামক স্থানে ৬ হাজার ইয়াজিদী সৈন্য তাঁর গতি রোধ করে এবং তাঁকে তার ৭৩ জন পারিবারিক সদস্য ও সঙ্গী-সাথীসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। ইমাম হুসাইন ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পথের এক আপোষহীন সৈনিক। অন্যায়ভাবে কারো কাছে মাথা নত করে ইসলামের মহান নবী নানাজীর আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে চাননি। ইয়াজিদ বাহিনী অপমানজনক অবস্থায় তাঁকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি মুষ্টিমেয় নিরস্ত্র ভক্ত-অনুরক্ত নিয়ে শাহাদাত বরণ করাই শ্রেয়ঃ মনে করেন। কারণ স্বাধীনভাবে একটি মুহূর্ত বেঁচে থাকা পরাধীন হাজার বছরের চেয়ে বেহতর। হুসাইন জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, পরিবারের সবাইকে কুরবানী দিয়েছেন, তবুও মান-সম্মান ও আদর্শ-বিশ্বাস বিকিয়ে দেন নি। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন ন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে কথা বলতে হয়। কিভাবে নিজ আদর্শ ও চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, সত্যকে সমুন্নত রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে অগ্রসর হতে হয়। তাই হুসাইন আমাদের আদর্শ, হুসাইন আদর্শ তামাম মজলুম মানুষের, সত্য ও ন্যয়ের পথের সাহসী সংগ্রামীদের।
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) যথার্থ বলেছেনঃ ইমাম হুসাইন মস্তক দিয়েছেন কিন্তু ইয়াজিদের হাতে হাত লাগান নি। প্রকৃত অর্থে তিনি হচ্ছেন ‘লা-ইলাহা ইলালাহ’(আলাহ ছাড়া কোন প্রভুর আনুগত্য মানি না) এ বিশ্বাসের ভিত্তি প্রস্তর। হুসাইন একজন সম্রাট, সম্রাটের সম্রাট। ইসলামের বর্ম। যদিও (ইসলামের জন্য) তিনি মস্তক দিয়েছেন কিন্তু ইয়াজিদের হাতে সত্য ধর্ম স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বিকিয়ে দেননি। সত্যিই হুসাইন ইসলামের বিপ্লবী বাণী ‘আলাহ ছাড়া মাথা নত করার কোন সত্তা নেই’- এর পুনঃ প্রতিষ্ঠাতা।’

আসুন, আমরা শাহাদাতে কারবালা দিবসে মহান শহীদদের স্মরণ করি এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে নিজেদের ঈমান ও দায়িত্ববোধকে মজবুত করি।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট