চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

কুপ্রভাব থেকে বাংলাদেশও রেহাই পাবে না

আমাজনে আগুনের লেলিহান শিখা

৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইন ফরেস্ট আমাজনে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ আগুনের ঘটনা আমাদের জন্য একটি অশুভ বার্তা। এ ধরনের ঘটনা একটি সুস্থ বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। আমাজনের আগুন স্পষ্ট করে দিচ্ছে কিছু অবিবেচক ও স্বার্থান্বেষীর মাত্রাহীন লোভের কারণে এই পৃথিবী সুস্থ থাকতে পারছে না। বিপুল সোনা-রুপা-হীরা ছাড়া তেল-গ্যাস প্রভৃতি মূল্যবান খনিজ পদার্থের ভা-ার হওয়ায় আমাজনকে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের অপতৎপরতা বিপজ্জনক ও উদ্বেগকর। বিশ্বপরিবেশের ওপর এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সন্দেহ নেই।

সর্বগ্রাসী আগুনের বৈশিষ্ট্যই বলে দিচ্ছে আমাজনের বুকে লুকিয়ে থাকা খনিজ পদার্থ অন্বেষণের জন্যেই এই চিরহরিৎ বনে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। বন পুড়িয়ে খনিজসম্পদ আহরণের জন্যেই যে আগুন লাগানো হয়েছে, তা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, গুটিকয় মানুষের লোভের আগুনে আমাজন পুড়ে ছাঁই হয়ে গেলে কি পৃথিবী সুস্থ থাকতে পারবে? পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত এই বনটি রক্ষায় এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ না নিলে কি সমগ্র প্রাণীজগৎ অস্থিত্ব সংকটে পড়বে না? যারা বন ধংস করে ফায়দা লুঠতে চায় নীরব থেকে তাদের আশকারা দিলে এক সময় সমগ্র মানবজাতিকে কি এর খেসারত দিতে হবে না? বাংলাদেশও কি এর কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?

উল্লেখ্য, ৯টি দেশের প্রায় ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে এই বনাঞ্চল বিস্তৃৃত। চিরহরিৎ বৃষ্টিবহুল এই বনের আয়তন বাংলাদেশের তুলনায় ৩৮ গুণ বড়। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ১৭ গুণ বেশি। পৃথিবীর বায়ুম-লে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশের উৎস এ আমাজন বনের গাছপালা। এজন্য এ বনকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয়। বায়ুম-লের প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড (২.২ বিলিয়ন মেট্রিক টন) শোষণ করে আমাজন বনের গাছপালা। সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ চিরহরিৎ বন বা রেইন ফরেস্ট আছে, তার অর্ধেকই হলো আমাজন। এই বনে ৪০ হাজার প্রজাতির প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি গাছ রয়েছে। আমাজন অরণ্যাঞ্চলে ৩০ লাখ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। ১০ লাখ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এই বনে। আধুনিক ওষুধ শিল্পের ২৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে আমাজন থেকে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগার তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথম কারণ বন উজাড়করণের মাধ্যমে খনিজ পদার্থ অনুসন্ধান। দ্বিতীয় কারণ ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষি কাজের সম্প্রসারণ। তৃতীয় কারণ খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তন খরার তীব্রতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। খরা রীতিমতো একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। পানি স্বল্পতায় জঙ্গলের গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক গাছে আগুন লেগে দাবানল সৃষ্টি হয়ে আরও বৃক্ষনিধন ঘটছে। ফলে বাড়ছে খরার তীব্রতাও। এই তিনটি কারণের সম্মিলন ফায়ার-প্রুফ রেইন ফরেস্টকে আগুনের কুন্ডলীতে পরিণত করেছে। তবে ইদানিং বনটি খনিজসম্পদ সন্ধানের প্রধান টার্গেটে পরিণত হওয়ায় দাবানলের ঘটনা বেড়ে গেছে। সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাজনে আগুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ব্যবধানে আগুনের ঘটনা ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযোগ আছে, ব্রাজিলের বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জঙ্গল উজাড়ে উৎসাহ দিচ্ছে। পরিবেশবাদীরা দাবানলের জন্য আমাজন নিয়ে বোলসোনেরো সরকারের নীতিকে দায়ী করছেন। দাবানলের এই ধারা চলমান থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই আমাজন অরণ্য বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।

আমাজন বনাঞ্চলে রেকর্ড অগ্নিকা-কে ‘আন্তর্জাতিক সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ধারাবাহিক অগ্নিকা-ে বনের বিশাল এলাকা পুড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। পরিবেশবাদীরা তো অনেক আগে থেকেই আমাজন রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে। আমরাও আমাজনের অগ্নিকান্ডে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। জলবায়ু সঙ্কটের মধ্যেই অন্যতম প্রধান অক্সিজেনের উৎস ও জীববৈচিত্র্যের আরও ক্ষতি আমরা পোষাতে পারব না। পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা সঠিক রাখতে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে এবং মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে আমাজন বনাঞ্চল রক্ষার বিকল্প নেই। আমাজনকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। যদি গাছ কেটে এবং আগুন ছড়িয়ে দিয়ে এই বন ধংস করে ফেলা হয় তাহলে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ আহরণের সুযোগ অবারিত হলেও সেখানকার আদিবাসীরা বিলুপ্তির পথে হাঁটবে। একইসঙ্গে বিশ্বপরিবেশও কল্পনাতীত পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এই ক্ষতির মাসুল দিতে হবে পৃথিবীর সব দেশকে, সব মানুষকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট