চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আসামের নাগরিকপঞ্জি

কাজী আবুল মনসুর

৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০০ পূর্বাহ্ণ

বৃৃহস্পতিবারের ঘটনা। উত্তর আসামের তিনসুকিয়ার নিকটবর্তি ধলা গ্রামে পাচঁ ব্যক্তিকে গুলি করা হত্যা করা হয়েছে। ভারতের বিজেপি সরকারের আসাম নাগরিকপঞ্জি ঘোষণার পর এটাই প্রথম হত্যাকান্ড। একসাথে পাচঁ বাংলাভাষী লোক হত্যার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। আসামে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস, জাতীয় কংগ্রেস, বাম দলের সাথে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারও প্রতিবাদে নেমেছে। এ প্রতিবাদ বাঙালি হত্যাকান্ডের সাথে সাথে নাগরিকপঞ্জিরও বিরুদ্ধে। কিন্ত এসব দলের প্রতিবাদ কতটুকু কাজ দেবে এটাই এখন দেখার বিষয়। বাঙালি হত্যার তীর গেছে আসামের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন উলফা’র দিকে। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ, উলফা নেতা মৃনাল হাজারিকা ও উলফা প্রধান পরেশ বড়–য়া আসামে বাঙালি নিধনের ডাক দিয়েছেন। তাদের এ ডাকের ফলে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, নাকি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ শুরু হচ্ছে তা নিয়ে ক্রমশ সংশয় বাড়ছে। তবে যাই হোক, আসামকে ঘিরে একটি পরিকল্পিত নীলনক্শার যে বাস্তবায়ন হতে চলেছে তা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

জার্মানীর দয়েৎসেভেলের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালে বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে ‘অবৈধ’ শব্দটি প্রযোজ্য হবে না বলে জানানো হয়। ফলে আসামের বহু পুরোনো ইস্যু ‘বাঙালি বা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ’ নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। সাথে যোগ করা হয় সাম্প্রদায়িক রঙ। এরপর থেকেই উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের হাত ধরে উত্তর আসামে বাড়তে থাকে বাঙালি বিদ্বেষ।

আসামে বহিরাগত-ভূমিপুত্র বিতর্ক অনেক পুরোনো হলেও ২০১৪ সালের নাগরিকপঞ্জি নবায়নের কারণে নতুন করে তা শিরোনামে উঠে আসে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর আসামে বাস করতে শুরু করা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। নতুন নাগরিকপঞ্জির অন্তর্ভুক্ত হতে আসামের নাগরিকদের নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করতে বিভিন্ন নথি পেশ করার কথাও বলা হয় সেখানে। এই প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্ব শেষে দেখা যায়, আবেদনকারী ৩ কোটি ২৯ লক্ষ আসামবাসী থেকে তালিকায় বাদ পড়ে যান ৪০ লক্ষের কিছু বেশি মানুষ। প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের নাগরিকত্ব। আসামে বসবাসকারী ‘ভারতীয়’ পরিবারের সংখ্যা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। এমন দেখা যায়, কোনো পরিবারের সন্তান তালিকার বাইরে, অথচ মা-বাবা দু’জনই তালিকায় বর্তমান। অথবা স্বামীর নাম তালিকায় রয়েছে, কিন্ত তাঁর স্ত্রী বা তাঁদের সন্তান অনুপস্থিত। প্রশ্ন ওঠে, কারা এই ৪০ লক্ষ মানুষ, যাঁদের ঠাই মেলেনি নাগরিকপঞ্জির সম্পূর্ণ খসড়ায়? কী-ই বা তাঁদের ভবিষ্যৎ?”

আসামের এই নাগরিকপঞ্জ নিয়ে এখন ভারত বাংলাদেশ দু’দেশেই তোলপাড় চলছে। যারা বাদ পড়েছেন তাদের জীবন কাটতে শুরু করেছে নানা শঙ্কার মধ্যে দিয়ে। কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ, কোথায় সন্তানদের পড়াশুনা, ভারতে তাদের বাস কিভাবে হবে। তারা যে এখন রাষ্ট্রহীন মানুষ?

ইতিহাস কি বলে। যদি আসামের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায়, আসাম ভেঙ্গে অতীতে অনেক টুকরো হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ২ আগস্ট ব্রিটিশ সংসদে ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ গৃহীত হয়েছিল। এই আইন দিয়ে ১৯৩৭ সালে আসাম প্রদেশের জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট বিধানসভা প্রনয়ণ করা হয়। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে বিধানসভার নিম্মকক্ষের প্রথম বৈঠক বসে সিলং-এ। আসামের রাজধানী ছিল সিলং। বিধানসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ১০৮। এই সদস্যরা সবাই ছিলেন নির্বাচিত। উচ্চ বিচার বিভাগের সদস্য সংখ্যা ছিল ২১ বা ২২ জন। বাংলাদেশের সিলেট জেলা তখন ছিল আসামের অন্তর্ভুুক্ত। পূর্বপাকিস্তান হবার পর সিলেট আসাম থেকে পৃথক হয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাভাবিকভাবে বিধানসভার আসনসংখ্যা কমে ৭১ হয়ে যায়। অবশ্য পরে আবার তা ১০৮ করা হয়। ১৯৪৭ সালে বিচার বিভাগের অবলুপ্তি ঘটলে আসামের বিধানসভা এককক্ষ বিশিষ্ট করা হয়। স্বাধীনোত্তর সময়ে আসাম বিভক্ত হয়ে অনেক নতুন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে ভারতের সংসদে গৃহীত হওয়া একটি আইনের মাধ্যমে মেঘালয়কে পূর্ণাাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়। মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশও আসাম থেকে আলাদা হয়ে যায়। মেঘালয় গঠনের পর সিলং আসাম এবং মেঘালয় উভয় রাজ্যের যৌথ রাজধানী হয়। ১৯৭২ সালে আসাম সরকার দিশপুরে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চে দিশপুরের অস্থায়ী রাজধানীতে আসাম সরকার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

উপরের ইতিহাসে প্রমাণ মেলে আসামের নাগরিকরা চর্তুদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা সবাই প্রকৃত ভারতীয়। কিন্ত বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের বহিরাগত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জোর প্রচেষ্টা চলছে। ৩১ আগস্ট বিজেপি সরকার যে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করেছে তাতে বিস্মিত হয়েছে ভারতের সাধারণ মানুষ। উগ্রবাদীরা ছাড়া প্রায় সবাই এ ঘটনায় হতাশ। কোন সভ্য দেশ ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের প্রতি এ ধরনের আচরণ করতে পাওে তা কল্পনাও করা যায় না। ভারত বিভাগ ও স্বাধীনতার পর থেকে যুগের পর যুগ চলে গেছে, কোন প্রশ্ন উঠেনি, অথচ এখন বিজেপি সরকার এতগুলো মানুষকে নিয়ে যে খেলা শুরু করেছে তার পরিনাম কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সে দেশের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার প্রধান এর উপস্থিতিতে ভারতীয় নাগরিকপঞ্জিতে ২ কোটি ৮৯ লাখ মানুষের নাম অন্তর্ভুুক্ত করা হয়। প্রথম দফায় বাদ পড়ে ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ বাদ। মোট আবেদনকারী ছিল ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪। ৪ লাখ মানুষ আবেদনই করেনি। ৩১ আগস্ট চূড়ান্ত তালিকায় বাদ দেয়া হলো ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনকে।
তাদের মতে, এখানে নাকি লাখ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। আসামের কাটিগড়ার প্রাক্তন এমপি আতাউর রহমান। সেখানে তার রয়েছে বিপুল পৈত্রিক সম্পত্তি, যা ১৯৪৬ সালে রেজিস্ট্রি করা। তার নামই বাদ। তার পুত্র নাজির আহমেদ ও কন্যা মরিয়ম কাউসারের নামও বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ প্রথমদিকে তাদের নাম ছিল। করিমগঞ্জ শহরের নেতাজি পল্লীর বাসিন্দা বিমলকর, দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে অবসর নেন। তালিকায় তার নাম না দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি ছিলেন পুলিশের চাকরিতে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এতদিন যে দেশের সেবায় নিয়োজিত ছিলাম আজ সে দেশের নাগরিক না, এটি অপমানিত হওয়া আর কিছু না। অথচ তার স্ত্রীর নাম রয়েছে তালিকায়। এভাবে অসংখ্য উদাহরণ ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে ফুটে উঠেছে। সবার একটাই প্রশ্ন, এটা কি ধরনের নাগরিকপঞ্জি।
লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক রেবেকা র‌্যাডক্লিপ ৩০ আগস্ট দিল্লী থেকে তার প্রতিবেদনে বলেন, ঐ অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই আনুপাতিকহারে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি উল্লেখ করেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এই এনআরসি রেজিস্ট্রিকরণ প্রক্রিয়াটি মূলত: বর্ডারের ওপারে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আগতদেরকে উদ্দেশ্য করেই করা হচ্ছে।
পত্রিকাটি বলছে, এন আরসি’র বাইরে বিজেপি সরকার মুসলিমদের বাদ দিয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনছে। জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বিষয়ক বিশেষ দূত ফার্নান্ড ডি বার্নেস বলেছেন, ভারত সরকারের এ পদক্ষেপের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচাইতে বড় সংখ্যায় মানুষের নাগরিকত্ব হারানোর ঘটনা ঘটতে চলেছে। তিনি বলেন, ভারতের এ প্রক্রিয়াকে বৈষম্যমূলক বলা যেতে পারে। মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস, গত ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সংস্করণে সাংবাদিক কাই শুলজ তার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আভাজ এর নির্বাহী পরিচালক রিকেন প্যাটেল এর বরাত দিয়ে বলেন, ’১৯৮২ সালে একই কায়দায় মায়ানমার সে দেশের বিশাল রোহিঙ্গা মুসলিম জনসংখ্যাকে নাগরিকত্ব দেয়া থেকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছে। প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থাটির কর্মকর্তা প্যাটেলের উক্তি উদ্ধৃত করে আশংকা প্রকাশ করে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এভাবে লক্ষ লক্ষ লোককে দেশছাড়া করার প্রক্রিয়াকে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, কেউ বিচার চাইতে পারছে না। কেন বাদ দেয়া হয়েছে তাদের এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তাদের নামের জায়গায় নানা কিসিমের সংকেত রয়েছে। অনেককে বলছে যারা জানতে চান, তাদের অনলাইনে জবাব দেবে সরকার। প্রকাশ্যে কোন চিঠিপত্রে নয়। আন্তর্জাতিক মহলে যাতে হৈ চৈ না হয় তার জন্য কৌশলও অবলম্বন করেছে সরকার। লোক দেখানো সুযোগ দেয়া হয়েছে আত্মপক্ষ সমর্থনের। যারা ক্ষুব্ধ তারা কথিত বিদেশী ট্রাইব্যুনালে আপীল করতে পারবেন। সেখানে বিচার না পেলে পথ খোলা রয়েছে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোট-এ। হাতে সময় দেয়া হবে ১২০ দিন।

বলা হচ্ছে বাদ পড়াদের কোন ডিটেনশন ক্যাম্পে নেয়া হবে না। গরীবদের আবেদনের জন্য সহায়তা দেবে সরকার। এর জন্য ২০০টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। সবকিছু মিলে আসামে এখন দিশেহারা অবস্থা। সিলেট সীমান্তে নজরদারী জোরদার করা হয়েছে। তাদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করার শঙ্কা থেকে সীমান্ত বাহিনী সতর্ক অবস্থায় আছে। আসামে বাদ পড়া মানুষদের ভবিষ্যত কোন পথে তা কেউ বলতে পারছে না। শেষপর্যন্ত আসাম ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কও কোন দিকে মোড় নেয় তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতুহল বাড়ছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট