চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আসামের নাগরিকপঞ্জি বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে

৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘ যখন রাষ্ট্রহীন মানুষদের সংকট নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিক তখনই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে বিতর্কিত চূড়ান্ত ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স’ (এনআরসি) বা নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়ে রাষ্ট্রহীন হয়ে গেলেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষ। তালিকাভুক্ত হয়েছেন তিন কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার চারজন। এর ফলে আসামের ১৯ লাখের বেশি মানুষ বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত তো বটেই, এমনকি পরিচয়হীনও হয়ে যাচ্ছেন। যাদের নাম বাদ পড়েছে তারা মূলত অতি দরিদ্র এবং বেশিরভাগই মুসলমান। বাংলাদেশ মনে করে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদপড়াদের যেহেতু বাঙালি পরিচয়ে বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে সেহেতু বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় আসামের রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়া মানুষজন যাতে সীমান্তপথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার জোরালো পদক্ষেপ দরকার।

নাগরিকপঞ্জির নামে নাগরিকহীন হয়ে পড়া এই বিপুল মানুষের ভাগ্য কেমন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। সমালোচকরা বলছেন, এতে বিজেপির নোংরা মানসিকতা ও রাজনীতির প্রকাশ ঘটেছে। দেশটির বিরোধীদলগুলো নাগরিকপঞ্জিকে উদ্দেশ্যপূর্ণ ও চরম ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছেন, বিজেপি যে বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতি করছে এই নাগরিকপঞ্জি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতাসীন বিজেপিরও অনেক নেতা নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রক্রিয়া ও ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির ভারপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়সহ বহু নেতাই শুধু আসাম নয়, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতেই নাগরিকপঞ্জি চালু করার হুমকি দিয়েছেন। দেশটির গণমাধ্যমও নাগরিকপঞ্জিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে সমালোচনা করেছে।

ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে আসাম হলো একমাত্র রাজ্য, যেখানে এনআরসি সম্পন্ন করা হলো। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের আসাম বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপি অভিযোগ করে আসছে, আসামে মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী’ বাড়ছে। তারা জোর গলায় বলে আসছে যে, ক্ষমতায় গেলে নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়ন করে কথিত অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাবে। তবে কোনো রাখঢাক না করেই তারা বলেছে কথিত মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। তথাকথিত নাগরিকপঞ্জির উদ্দেশ্য কি তা তাদের এই বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয়। উল্লেখ্য, গত এপ্রিল-মে মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ইশতেহারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ, এনআরসিতে অগ্রাধিকার এবং অন্যান্য রাজ্যেও সম্প্রসারণের। বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বেশ আগেই কথিত অবৈধ বাসিন্দাদের ব্যাপারে ইংরেজিতে ‘থ্রি ডি’ ‘ডিটেক্ট’ (চিহ্নিতকরণ), ‘ডিলিট’ (বাদ দেওয়া) ও ‘ডিপোর্ট’ (বহিষ্কার) করার নীতির কথা বলেছিলেন। অকাট্য কোনো প্রমাণপত্র না থাকার পরও ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতাকর্মীদের বক্তব্যে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদপড়াদেরকে বাঙালি পরিচয়ে বাংলাদেশি হিসেবে শণাক্ত করার চেষ্টাও চলছে। যদি তাই করা হয় তাহলে রাষ্ট্রহীন এসব নাগরিককে সীমান্তপথে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টাও হতে পারে। সে অবস্থায় বাংলাদেশকে সতর্ক অবস্থান গ্রহণের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ বরাবরই আসামের এনআরসিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করে আসছে। ভারতীয় কূটনীতিকরাও এনআরসিকে তাঁদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন। সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেছেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরাও মনে করি, নাগরিকপঞ্জির ব্যাপারটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এনআরসির মাধ্যমে যাদেরকে রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেবে তা ভারতের বিষয়। তবে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছে আমরা আশা করবো, নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়াদের যেন বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা না করা হয়। ভারতের লোকসভায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল’ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। এটা এখন রাজ্যসভায় পাসের জন্য অপেক্ষমাণ। ওই বিল পাস হলে বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ সন্দেহ নেই। তবে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ আছে। আমরা বন্ধুদেশটির কাছে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘সংখ্যাগুরু’ মনস্তত্ত্বের পরিবর্তে দেশটির মুসলমানদের ক্ষেত্রে ন্যায়ভিত্তিক পদক্ষেপ প্রত্যাশা করি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ভারত সরকার এমন কিছু করবে না, যাতে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়, বিনষ্ট হয় বিদ্যমান সম্প্রীতি ও শান্তি। একইসঙ্গে পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে ভারত সরকার রাষ্ট্রহীন হয়েপড়া মানুষদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করবে না, এমনটিও আশা করতে চাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট