চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমার প্রিয় শিক্ষক

অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নুরজাহান ভূঁইয়া

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শফিউল হাসান

৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশের আদর্শ মেডিকেল শিক্ষক প্রখ্যাত গাইনেকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নুরজাহান ভূঁইয়া (৮০) গত বুধবার দিবাগত রাত ৩টায় অসুস্থতাজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। আমরা তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। সাথে সাথ আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নুরজাহান ভূঁইয়া ১৯৩৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার ধানম-ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইডেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি এবং ইডেন মহিলা কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এম বিবিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রীর সুযোগ না থাকায় তিনি লন্ডন থেকে এমআরসিওজি ডিগ্রী এবং এফআরসিওজি ডিগ্রী লাভ করেন। দেশে ফিরে এসে ১৯৬৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে গাইনেকোলজী বিভাগে যোগদান করে পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১৯৭২ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে।

শিক্ষক হিসাবে অধ্যাপিকা ডা. সৈয়দা নুরজাহান ভূঁইয়া ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষক। আমার জীবনে এতো ভালো শিক্ষক আর দেখিনি। ১৯৭৫ু সালে আমরা যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে যোগদান করি তখন থেকে মেধাবী শিক্ষক এবং চমৎকার ব্যক্তিত্ব হিসাবে ম্যাডামের নাম সব ছাত্র-ছাত্রীর নজর কেড়ে নেয়। এমবিবিএস ৩য় বর্ষ থেকে শুরু হলো ম্যাডামের গাইনী ক্লাস। গ্যালারী ভর্তি ১৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী। এতো সুন্দর উপস্থাপনা যা বলার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিনপতন নিরবতা সমগ্র গ্যালারীর সামনে থেকে পেছনের সারি পর্যন্ত। ক্লাশে ছাত্রদের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অসাধারণ। কণ্ঠস্বর কোকিল কণ্ঠ বললেও কম বলা হবে। তৎকালীন সময়ে মাল্টিমিডিয়ার প্রচলন ছিলনা বলে সরাসরি মৌখিকভাবে লেকচার দেয়া লাগতো। লেকচার ছিল সেরকম।

চক্ষু-কর্ণ থাকতো সদা জাগ্রত। মন থাকতো সতেজ। ক্লাশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরতিহীন উপস্থাপনা। বিলাতের লেখক ঔধভভপড়ঃ এর লেখা বইয়ের আলোকে উপস্থাপনা। পুরো লেকচার লেখা হতো এবং শুনা হতো। পড়ার জন্য নতুন কোন শিক্ষকের প্রয়োজন হতো না। সময়ের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। সময় মতো শুরু করতেন এবং সময় মতো শেষ করতেন। আমার মনে হয় পাঠদানের ব্যাপারে ম্যাডাম ছিলেন সদা জাগ্রত এবং সচেতন। ক্লাশ না নিয়ে থাকতে পারতেন না। ওয়ার্ডে ক্লাশ নেয়ার ব্যাপারেও ছিলেন যত্নবান। জুনিয়র শিক্ষকরা শিক্ষাদানের ব্যাপারে ম্যাডামের অনুপ্রেরণায় প্রাণিত ছিলেন।
চিকিৎসক হিসাবে ডা. নুর জাহান ভূঁইয়া ছিলেন একজন আদর্শ চিকিৎসক। তিনি ছিলেন একজন মানবদরদি রোগী বান্ধব চিকিৎসক, ছিলেন একজন দক্ষ গাইনী সার্জন। ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনিক কাজেও ছিলেন পারদর্শী। ম্যাডামের সময়কালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গাইনী বিভাগের সুনাম সবার জানা আছে। রোগীর ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। আমরা চিকিৎসকরা দেখেছি ম্যাডাম সারাজীবন সময়মতো ওয়ার্ডে আসতেন। রাউন্ড দিতেন। ছাত্রদের নিয়মিত ওয়ার্ডে ক্লিনিক্যাল ক্লাশ নিতেন। অফিসসময়ের পরেও রোগীদের খোঁজ খবর নিতেন। তাঁর সুযোগ্য স্বামী জনাব আমিনউজ্জামান ভূঁইয়া একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি ও বিশিষ্ট সমাজসেবক।

ম্যাডাম অনেক সময় রোগীদের স্বার্থে বিদেশ যেতে চাইতেন না। তাঁর বাসায় ( মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেইট সংলগ্ন) একদিন বলতে লাগলেন “ দেখ শফি তোমার দুলাভাইকে বুঝাতে পারছি না যে, আমার রোগীদের ঊউউ আছে এবং রোগীদেরকে ম্যানেজ করতে হবে। তার কারণ হলো রোগীরা আমাকে বিশ^াস করে এবং আমার উপর আস্থা রাখে বলে আমি বিদেশ ভ্রমণ করতে চাচ্ছি না। সরকারী হাসপাতালের সেবার পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন সবার পরিচিত “হিলভিউ ক্লিনিক”। তৎকালীন সময়ে বেসরকারী উদ্যোগে মেটারনিটি ক্লিনিক ছিল হাতে গোনা কটি। আমি যতটুকু জানি ভোর বেলা ওঠে ইবাদত করে এবং পারিবারিক কাজ সেরে অপারেশনের কাজ সমাপ্ত করে সঠিক সময়ে অফিসে যেতেন। সারা জীবনটাই এমনিভাবে কাজ করে গেছেন। একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক হিসাবে ডা. নূর জাহান ম্যাডামকে চট্টগ্রামের রোগীরা সবাই চিনতেন। তিনি অত্যন্ত মায়াবী একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। চট্টগ্রামের জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় যান নি। চট্টগ্রাম থেকেই বিদায় নিয়ে পরকালে চলে গেলেন। ম্যাডামকে আপা বললেই খুশী হতেন। দীর্ঘদিন আপার সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল যেহেতু আমার সহধর্মিনীও ডা. তাহের বেগম ও একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ।
অধ্যাপক ডা. নুরজাহান ভূঁইয়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দক্ষতার সাথে কাজ করে সবার প্রশংসার পাত্র ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন হিসাবে ৯ জুন ১৯৯৩ থেকে ২৬ মার্চ ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সার্থকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসাবে ১৯৯২-১৯৯৩ সাল, ১৯৯৩-১৯৯৪ সাল এবং ১৯৯৪-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পর পর তিনবারের মতো সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করে সকল শিক্ষকের মন জয় করেছেন। তিনি কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নাই। অত্যন্ত সাহসী প্রশাসক এবং দূরদর্শিতার সাথে প্রশাসনিক কর্মকা- পরিচালনা করেছেন। তিনি সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারিদের ¯েœহ করতেন। তিনি প্রতিবার ঈদের সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পাশর্^বর্তী নিজ বাসায় অবস্থান করতেন। আপাকে ঈদের সময় বলতে শুনেছি “আমার অফিসের গরীব কর্মচারীরা যেন আমার এই বাসায় আসতে পারে”। সবাই নিজে বসে আপ্যায়ন করতেন। তিনি গরীব লোকদের প্রতি এতই দরদী ছিলেন যে, ম্যাডামের বাসার কাজের লোক সামাদ এবং তার পরিবার” দীর্ঘদিন থেকে তাঁর বাসায় থাকেন। সামাদের ছেলে মেয়েদের সব খরচ আপাই বহন করতেন। যার কথা না বললে অকৃতজ্ঞতা হবে তিনি হলেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত গাইনী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশন মোরশেদ। যিনি আপাকে মায়ের মতোই সেবা প্রদান করেছেন। আমাদের সহকর্মী ডা. উমা চৌধুরী দীর্ঘদিন ম্যাডামের চেম্বারে এবং ক্লিনিকে সেবা প্রদান করে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। আজ তার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো সর্বষÍরের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনের মাঝে নাড়া দিচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নুরজাহান ভূঁইয়া বিজিসি ট্রাস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, চসিক মেয়রের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তাঁর রচিত প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বহুল পরিচিত বই ‘ক্লিনিক্যাল গাইড টু অবসটেটিকস এন্ড গাইনেকোলজী’ সারা বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের নিকট ‘নুরজাহান’ হিসাবে সুপরিচিত। ম্যাডাম রয়েল কলেজ অব অবস্হেটক্স এন্ড গাইনেকোলজীর সদস্য এবং এমআরসিওজি পরীক্ষার পরীক্ষক।

সারাবিশে^ বিভিন্ন সেমিনার ও সিমপোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর শিক্ষার আলোয় সারা বিশ^ আলোকিত। এমন একজন মহান শিক্ষাবিদ চিকিৎসকের বিদায় বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা চিকিৎসকরা যদি তাঁর আদর্শ এবং নুর অনুসরণ করতে পারি তাহলে তাঁর বিদেশী আত্মা শান্তি পাবেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর বাসায় আলাপচারিতায় যখন বললাম আপা আপনিতো অনেক সেবা দিয়ে গেছেন যার সবাই আপনার জন্য দোয়া করেন। তখন তিনি নিরবে হ্যাঁ বললেন।
আমরা চিকিৎসক সমাজ এবং অন্যান্য পেশাজীবী সমাজ এবং দেশবাসী তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি, যাতে তিনি পরকালে জান্নাতের অতিথি হিসাবে থাকতে পারেন।

লেখক : মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ,
ইউএসটিসি ফয়েজ লেক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট