চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

আমাজনের আগুনে অস্তিত্বের দহন

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর অন্যতম প্রধান প্রাণমূলধন সবুজ। সবুজ আছে বলেই পৃথিবীতে প্রাণ আছে, প্রাণের স্পন্দন আছে। জীবনের চাষবাস আছে। পানি, বাতাস, মাটি, সবুজ-পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। অমূল্য অর্থ মূল্যহীন নয়। যা মূল্য পরিশোধ করে অর্জন করা যায় না। পৃথিবী নামের গ্রহেই শুধু সবুজ আছে। পৃথিবীতে বনই আদি মানবতার মূল আবাস। এ পৃথিবীতে পানি আছে, সবুজ আছে, প্রাণ আছে। মানুষের জীবন চর্চায়, নানাবিধ কর্মকান্ডে পানি বিনষ্ট হয়েছে, বাতাস দূষিত হচ্ছে। দেশে দেশে আজ সুপেয় পানি আর বিশুদ্ধ বাতাসের হাহাকার।

পৃথিবীতে প্রাণের মূলধন দূষিত হচ্ছে। দূষণ এখন বিশ্বব্যাপি মানুষের সকল প্রকার কাজকর্মের অন্যতম প্রধান সঙ্গী। মানুষ দৈনন্দিন কাজ কর্মে বন পাহাড়কে উজার করছে। বাতাস, মাটিকে দূষিত করছে। এ দূষণ ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে অসীমের দিকে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজন জ্বলছে। সবুজের সমারোহের একমাত্র গ্রহ পৃথিবীর হৃদপিন্ড বলে খ্যাত মহাবৃষ্টিবন আমাজন পুড়ছে।

শোষক আর শোষিতের দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবী এখন দূষক আর দূষিতের অরাজক পৃথিবীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। উন্নয়ণ আর উচ্চাভিলাসের যে পৃথিবী, তা সত্যকে অস্বীকার করে, পরিবেশকে বিপরীতে রেখে চলতে গিয়ে বিদিশাগ্রস্ত, মরণাপন্ন। বিশ্বময় এ দশারই সর্বশেষ নিদর্শণ আমাজনের আগুন। হৃদপিন্ডের ঘরে দহন। ‘রোম পুড়ে, নিরু বাঁশি বাজায়।’ জাইর বালশোনারো নীরব থাকে। কর্পোরেট দুনিয়া নির্লিপ্ত থাকে। আমরা যারা অক্সিজেন ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচতে পারিনা, তারাও নীরব, নির্লিপ্ত। এই না হলে পৃথিবীর এ দশা! আমাজনের বন পৃথিবীর তাপমাত্রাকে শোষণ করে, প্রশমিত করে। পৃথিবীর উষ্ণায়ণ নিয়ন্ত্রণ করে। আমাজন পৃথিবীর বাতাসের ২০-২৫% কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। কার্বন ডাই অক্সাইড রং স্বাদহীন নীরব বিষ। সাগর এবং পাহাড় বন একে শোষণ করে। আমাজন এটি শোষণ করে। পৃথিবী শীতল হয়। আমাজনের বন বাতাসে ১৮- ২৪% অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। আমাজন কি বহুদূর? নাকি আমাদের ফুসফুসের পাশে? আমাজন আমাদের ফুসফুসের পাশে, অস্থিত্বের সাথে।
একদিকে তাপ শোষণ করে পৃথিবীকে শীতল করা, অন্যদিকে অক্সিজেন ছেড়ে জীবের জৈবিক প্রকৃয়াকে জীবন্ত রাখা। এর জন্য আমাদের কিছুই পরিশোধ করতে হয় না। আমাদের সভ্যতা ভব্যতা চলা বলা সবকিছুর সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড়তা কমে যাওয়ার সাথে সাথে আমরা প্রকৃতির সবচেয়ে বড় শত্রুতে রূপান্তরিত হতে চলেছি। এটিই সভ্যতার বড় সংকট। অকৃতজ্ঞতাই আমাদের কৃতজ্ঞতার বড় মাপকাঠি।

আমাজনের আগুনকে অতিসভ্যতার আগুন বলা যায়, উন্নয়নের আগুন বলা যায়। আমাজন পুড়ছে কর্পোরেট সভ্যতা বাঁশি বাজাচ্ছে। প্রায় তিন হাজার বর্গ কিলোমিটারের বনভূমি আগুনের লেলিহান শিখার আওতায় আছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এ বিপর্যয়কে কোনভাবেই উষ্ণ আবহাওয়া বা প্রাকৃতিক কারণে বলা হয়নি। পরিবেশবাদীরা একে বালশোনারিজম বলেছেন। যিনি পরিবেশ ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুসারী করে তুলেছেন। যে গোষ্ঠি ইতিমধ্যেই পরিবেশের বিশ্বসভা থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। যারা পেরিস চুক্তি বা পরিবেশ সংহতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছেন বেশ কিছু দিন। আমরা কি পরিবেশের জন্য খুব খারাপ সময় অতিক্রান্ত করছি? ব্রাজিলের লক্ষ্য, বন উজাড় করে কৃষি, পশুপালন এবং সয়াবিন উৎপাদন। একটা দেশের উন্নয়ন ভাবনায় অনেক কিছুই থাকতে পারে। সার্বভৌম কোন দেশ তাদের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাবে, এটিই প্রচলিত প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রক্রিয়াটির সাথে যদি নিবিড়ভাবে গ্লোবাল স্বার্থ সংযুক্ত থাকে, তবে তার বিষয়ে গ্লোবাল চিন্তাচেতনাও অংশীজন, অংশীদার। কারও ভূখন্ডের সীমানায় পৃথিবী ধংসের লীলা চলতে থাকলে পৃথিবীর মানুষ চোখে শশার খোসা লাগিয়ে বসে থাকতে পারেনা। তা অন্যায়। দুর্ভাগ্য হলো, এ প্রক্রিয়ার সাথে ব্রাজিলের পরিবেশ আইন সংমিশ্রিত। লক্ষ্য, এ বন থেকে বেশি মাংস, বেশি সয়াবিন, বেশি দানাদার শস্য উৎপাদন। এ মহাবনকে উজার করে উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করা হচ্ছে। তথ্যমতে, ২০১৯ সালেই আমাজন সর্বোচ্চ হারে আগুনে পুড়েছে। এটি রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। সভ্যতার নামে চরম অসভ্যতা। উন্নয়নের নামে অবনয়ন।

ব্রাজিলের আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ। বনের সাথে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার যে নিবিড়তা, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ সবুজ গ্রহের বৃহত্তম গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাকৃতিক পরিবেশকে যদি কৃষিজকর্ম তথা গবাদিপশু পালন, সয়াবিন , দানাদার খাদ্যের চাষ, তেল আহরণ ক্ষেত্রে পরিণত করতে হয়, তবে একে আরও পোড়াতে হবে, বন আরও ধংস করতে হবে। বালশোনারিজম তত্ত্ব এটিই কিনা, পৃথিবীর মানুষকে ভাবতে হবে। জাগতে হবে। রুখতে হবে।
অধিকন্তু, এই মহাবনের একমাত্র নদী তাপাযোস, যার ওপর কোন ডেম বা বাধ ছিল না কখনও। ওখানকার আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে এ নদীতে ডেম তৈরীর পদক্ষেপও নিতে যাচ্ছে ব্রাজিল সরকার। এসব কর্মকান্ড বলে দেয় আমাজনের আগুন প্রাকৃতিক নয়, মানুষের সৃষ্ট।
বন পৃথিবীর আদি আবাস। মানুষ এবং অন্য সকল প্রজাতির উৎসভূমি। বন থেকেই আমাদের ক্রমবিস্তৃৃতি ঘটেছে। বনই আমাদের শেকড়। বনকে যারা এখনও ধারণ করে, পরিচরযা করে তারা আমাদের আদি পুরুষ। আমাদের শেকড়। শেকড়কে ভুলে শিখরের সন্ধান করা বৃথা। আমরা তা যথারীতি করি।

পৃথিবীর দেশে দেশে বন উজার করা হয়। ইতিমধ্যেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে মিলিয়ন মিলিয়ন হেক্টর বন। বনই যদি আমাদের শেকড় হয় তবে বিশ্বব্যাপি প্রতিজন জীবিত সত্তাকে বন হয়ে বন নিধন ঠেকাতে হবে বিশ্বব্যাপি। ব্রাজিলের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ কি তা করবে? এ পৃথিবী আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে ধার নেয়া। এর প্রতিভু-প্রতিনিধি নিরঙ্কুশ ভাবে তারাই। আর তাদের জন্য একে অক্ষত রাখা আমাদের প্রাকৃতিক প্রতিশ্রুতি। মাতৃত্বের প্রতিশ্রুতি। আমার বেঁচে থাকা অক্সিজেনের জন্য আমি আমার উদ্ভিদ-বনের কাছে ঋণী। আমার খাবার, ঔষধ, বস্ত্র, আবাসের জন্য আমি বন-উদ্ভিদকে নির্ভর করি।
আমার পুষ্টি ,স্বাস্থ্যের জন্য আমি বনের উদ্ভিদভোজি প্রাণি এবং ফলমুল, শাকসবজি নির্ভর। বনের উদ্ভিদ আমার গৃহ আসবাব- আবাসন দেয়। আমি সৃষ্টি জীবের ভিতর সচেতন, সভ্য, সুশীল। আমার বোধ আছে, বিবেকও আছে। পবিত্র গীতার ভাষায়, ‘কী নিয়ে এসেছিলে, কী নিয়ে চলে যাবে। এসেছিলে নিসঙ্গ নি:স্ব, চলে যাবে নিসঙ্গ। যা পেয়েছ, এখান থেকেই পেয়েছ। তাহলে কিসের এতো বিলাপ।’ পৃথিবীতে এসে জীবনের জন্য উৎকৃষ্ট উপহার উম্মুক্ত বন, বাতাস, জল, মাটি, পেয়েছি আমরা। মনের মতো করে ব্যবহার ও অপচয় করছি। বন উদ্ভিদ কেন আমার হাতে নিরাপদ নয় তাহলে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এসবের উত্তরেই বোধ বিবেককে জাগাতে পারে। আমাদের জেগে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। হৃদপিন্ডকে ধংস করে যে দেহ, তার কোন মূল্য নেই। বন আমাদের প্রাকৃতিক হৃদপিন্ড। আমাদের আগামী প্রজন্মকে পরিবেশ সংরক্ষণের সুশিক্ষায় তৈরী না করে আমরা তাদের পৃথিবী আর পরিবেশকে আমাজন প্রক্রিয়ায় ধংস করতে পারি না। আসুন, আমাজনের প্রতি সংহতি জানাই। অক্সিজেন তৈরীর সকল প্রকার কারখানাকে সব রকম ধংসের কালোহাত থেকে রক্ষা করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলীগবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট