চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গা সমস্যা : বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে থেকে লাভ কি?

ফরিদুল আলম

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

রোহি ঙ্গা সমস্যার দুইবছর পূর্তি হল গত ২৫ আগস্ট। এই সংকটের শুরু থেকেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রশংসা করা হয়েছে এবং সেই সাথে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ভূমিকার ব্যাপক নিন্দা জানানো হয়েছে। এতকিছুর পরও কিন্তু এই সংকটের একবিন্দু সমাধান হল না। উপরন্তু প্রত্যাবাসনের ব্যর্থ নাটক উপস্থাপন করা হল দু’বার। একটি জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে উৎখাত করে দেয়ার যে প্রয়াস, তার ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অথচ কার্যকর কোন আন্তর্জাতিক চাপ আমরা লক্ষ্য করলাম না, যার ফলে নিজ দেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এর বিপরীতে এখন এটা অনেক বেশী পরিষ্কার যে এই প্রত্যাবাসন নাটকের আড়ালে এদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আর এই অংশটি ক্যাম্পের ভেতর বাস করা অপরাপর রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত না যাবার ব্যাপারে হুমকী দিচ্ছে। যার ফলাফল হচ্ছে তারা ধীরে ধীরে জেঁকে বসছে এবং অনেকটা দিবালোকের মত এটা স্পষ্ট হতে শুরু করছে যে, একটা সময় হয়ত প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আর সেরকমভাবে থাকবে না।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এর আগে ৯০ দশকের শুরুর রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাও কিন্তু পুরোপুরি মেটেনি। সে সময়ের ২৬ সহস্রাধিক নিবন্ধিত শরণার্থীকে আজও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার সরকার। অধ্যাবধি তারা কক্সবাজারের দুটি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে এবং তাদের সংখ্যা বেড়ে এখন ৩৫ সহস্রাধিক। প্রায় ৩০ বছরের পুরানো সমস্যাই যেখানে মেটেনি সেখানে নতুন করে সৃষ্ট সমস্যা মেটা যে খুব সহজ নয় এটা এখন পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গারা এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় মানবিক সমস্যা। দুবছর ধরে অনেকটা চাহিদার অতিরিক্ত সাহায্য প্রাপ্তি এবং বারবার বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এর সমাধানে পাশে থাকার আশ্বাস জানানো রাষ্ট্রগুলো এখন অনেকটা পিছু হটতে শুরু করছে। যার ফল হচ্ছে মিয়ানমারের উপর দৃশ্যমান কোন আন্তর্জাতিক চাপ না আসা। সেই সাথে এ সময়ের টাটকা খবর হচ্ছে, দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণার পর আজ (২ সেপ্টেম্বর) থেকে থাইল্যান্ড উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র এবং আসিয়ানভূক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে মিয়ানমারও। এখানে একটা যুক্তি থাকতে পারে যে মিয়ানমার যেহেতু আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই মহড়া যৌথভাবে আসিয়ান জোটের সাথে হচ্ছে এবং মিয়ানমার যেহেতু আসিয়ানের অন্যতম সদস্য দেশ, সেক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। যুক্তি মেনে নিলাম। কিন্তু আসিয়ানের অপরাপর দেশুগুলোও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে কমবেশী সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি মিয়ানমারকে আসিয়ানের সদস্য করে রাখা এবং এই আসিয়ানকে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের একত্রে পথচলা তাদের লোকদেখানো নিন্দা প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। সেই সাথে চীনের বর্তমান ভূমিকা থেকে আরও স্পষ্ট যে তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে এই সমস্যা জিইয়ে রাখতে সব ধরনের আসকারা দিচ্ছে। শুধু মিয়ানমার কেন, সমস্যার শুরু থেকে আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের ভূমিকা আমাদের আহত করেছে দারুণভাবে।

সবকিছু মিলে এখন যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে তা হচ্ছে আমাদের কূটনৈতিক সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা। গত ২৯ আগস্ট আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করার তাগিদ দিয়েছেন। এদিকে নতুন খবর হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের প্রত্যাবাসন ব্যর্থতার পর বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে মধ্যে আলোচনায় চীনকে সাথে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। জানিনা আমাদের নীতি নির্ধারকরা এটিকে কিভাবে দেখছেন। এখানে যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হচ্ছে যেনতেনভাবে এই প্রত্যাবাসন আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করতে পারলে কার্যত মিয়ানমারকে দায়মুক্তি দেয়া যাবে আর সমস্ত দায় এসে পড়বে বাংলাদেশের ঘাড়ে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য কমতে শুরু করেছে। এবছর মোট প্রয়োজনীয় ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে বছরের প্রথম সাতমাসে মাত্র ৩৪ শতাংশ সাহায্য এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আড়াইহাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এই বিশাল রোহিঙ্গারা দিন দিন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে সরকার নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতেই নিত্য হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর নিরাপত্তা প্রদান যে কত দুরুহ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর সাম্প্রতিক সময়ে এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট যে রোহিঙ্গা শিবিরিগুলোতে ব্যাপকহারে অপরাধ তৎপরতা বেড়ে চলেছে এবং আমাদের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকটা নাকের ডগায় এগুলো সংঘঠিত হচ্ছে। গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গারা যে মহাসমাবেশ করল সেখানে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অংশগ্রহণ এবং তাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর বিষয়ে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ থেকে এটা স্পষ্ট যে আমাদের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে গভীর খেলায় মত্ত রয়েছে কিছু মহল। দিন দিন এভাবে পরিস্থিতি আমাদের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। যেখানে উখিয়া এবং টেকনাফের মোট জনসংখ্যা ৫ লাখের কিছু বেশী সেখানে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার উপস্থিতি ধীরে ধীরে আমাদের নিজভূমে পরবাসী করে তুলছে কি না সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।

এখন এটাও অনেকটা পরিষ্কার যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যখন আসছে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে মিয়ানমার সরকারের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল এবং বিষয়টি নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার উদ্যগ নেয়া হচ্ছিল সে সময় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার গোটা ব্যর্থতা মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা আমাদের সরকার কর্তৃক মানবিক আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে এ ধরনের একটি ঘটনায় জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মানবিক আচরণ প্রদর্শন কি খুব জরুরী ছিল কিনা। যেখানে ইতোপূর্বের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এক্ষেত্রে শৈথিল্য ছিল সেখানে এর মাধ্যমে নতুন করে নতুন সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানানো হল।

আর কালবিলম্ব না করে আমাদের এখন কূটনৈতিকভাবে জোর তৎপরতা চালাতে হবে। আমরা যে তাদের প্রতি সাময়িক সময়ের জন্য মানবিক আচরণ প্রদর্শন করেছি সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। আর নমনীয়তার প্রকাশ নয়, তাদের ফেরত যেতেই হবে এবং যেকোন মূল্যে তাদের ফেরত পাঠাতে সরকার বদ্ধপরিকর, সেটা বুঝিয়ে দেয়া এখন খুব বেশী জরুরি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট