চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গা বিড়ম্বনার শেষ কবে?

পূর্ব প্রকাশিতের পর

নাওজিশ মাহমুদ

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

তারা থাকলে অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক সমস্যা এবং উন্নয়নের পথের কাঁটা, সেই সাথে রাষ্ট্রীয় সমস্যাও আছে। অপরদিকে মানবিক কারণে বের করেও দিতে পারছে না। রোহিঙ্গারা মুসলিম এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম এই কারণে। এই ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দুটোকে নিয়ে তাঁকে সমীকরণের সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হচ্ছে। গভীর সমুদ্রবন্দর জটিলতা থেকেও এই সমস্য্যার উদ্ভব হতে পারে। পেকুয়ায় চীনের সাথে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরের পরেও ভারতের বিরোধীতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়। চীন এর পরিবর্তে রাখাইনে গভীর সমুদ্র বন্দরের সুযোগ পায় মিয়ানমারের কাছ থেকে। মিয়ানমার এ সুযোগে চীনের সম্মতিতে রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা শূন্য করার পরিরকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। তার পরিণতি হলো বর্তমান রোহিঙ্গ সমস্যা।

এই রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে মিয়ানমার সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। নাগরিকত্ব দিতেও প্রস্তুত ছিল অন্যান্য জাতিসত্তার মত। কিন্তু সৌদি এবং পাকিস্তানের মদদে তারা বাঙালি না হয়ে রোহিঙ্গা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে চাচ্ছে, যার ভিত্তি হচ্ছে মুসলিম পরিচিতি। রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বস্থানীয় লোকের অধিকাংশ পাকিস্তানে বসবাস করে। পাকিস্তান থেকে রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে হঠকারিতার মাধ্যমে জটিল করে তুলেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ করতে গিয়ে এই সমস্যাটাকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমার অং সান সুকীর গণতান্ত্রিক শক্তির দ্বন্দ্বেও এই রোহিঙ্গারা বলির পাঁঠা হয়ে পড়েছে। নির্বাচনে অং সান সুকীকে সমর্থন করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর রোষানলে পড়েছে। সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের আরাকান রাজ্য থেকে বের করে দেয়ার অপূর্ব সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে।

যদি অং সান সুকী রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকে, তা হলে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ তার বিরুদ্ধে চলে যাবে। আর অং সান সুকী যদি রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া সমর্থন করে, তা হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নষ্ট হবে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অং সান সুকীর অসহায়ত্ব পশ্চিমা বিশ^ আঁচ করতে পেরেছে। তাই, তারা যত নিষোধাজ্ঞা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের উপর প্রয়োগ করেছে। চীনের কারণে পশ্চিমা বিশ^ মিয়ানমারের ব্যাপারে কোন কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে পারছে না।

মাঝখানে বাংলাদেশ বিনাদোষে শাস্তি ভোগ করছে। প্রতিবেশীর প্রতি মানবিক আচরণ দেখাতে গিয়ে তার এই বিড়ম্বনা। তারা বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিলে না হয় বাংলাদেশের এই মানবিক সাহায্য আত্মতৃপ্তির একটা ব্যাপার থাকতো। কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সৃষ্ট এই বাঙালিদের জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে সারা বিশে^র বাঙালি প্রতি তাঁর একটি নৈতিক দায়িত্ব থাকে।
কিন্তু রোহিঙ্গারা চট্টগামের আঞ্চলিক ভাষাকে তাঁদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নতুন বর্ণমালার ভিত্তিতে একটি জাতিগোষ্ঠীতে রূপান্তরে চেষ্টা করছে। মুসলিম পরিচিতি তাঁকে বৌদ্ধদের সাথে সংঘাতে নিয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল ও দৌলত কাজীর স্মৃতি বিজড়িত আরকান রাজ্য বা বর্তমানে রাখাইন বাংলাভাষার চর্চার কোন উত্তারাধিকার বহন করে না। ফলে বাংলা ভাষায় হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে অসাম্প্রদায়িক এবং উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তা থেকে রোহিঙ্গারা বঞ্চিত। যদিও এই রোহিঙ্গাদের একটি অংশ হিন্দু ও খৃস্টান থাকা সত্ত্বেও কেন ধর্মের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পরিচিত লাভ করলো তা বোধগম্য নয়। হযতো বৌদ্ধ রাখাইনদের সাথে বসবাস করতে গিয়ে যে জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত হয়, তাতে ধর্ম সামনে চলে আসে। জাতি সত্তা হারিয়ে যায়। কারণ বৃটিশ আমল থেকে তাঁদের মধ্যে এই সংঘাতের বীজ বপন হয়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় মিয়ানমার যখন জাপান কর্তৃক দখল হয়, তখনও জাপানের সহযোগিতায় রাখাইনরা এই রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। তখন এই রোহিঙ্গারা বৃটিশদের পক্ষ নিয়ে জাপান দখলদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। কিন্তু বৃটিশরা তার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু না করে মিয়ানমারের মধ্যে রেখে চলে যায়। বৃটিশরা মিয়নামার ছেড়ে যাওয়ার সময় রাখাইন এবং রোহিঙ্গারা যৌথভাবে রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য দাবী তুলেছিল। বৃটিশরা তা না করে, অন্ততপক্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রোহিঙ্গা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল সমূহকে পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁদের সমর্থনের প্রতিদান দিতে পারতো। তাও দেয় নি। সংঘাতের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা রেখে চলে গিয়েছে। তার জের এখনও টেনে বেড়াচ্ছে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। নাগরিকবিহীন সাড়ে চব্বিশ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে বাস করছে। মিয়ানমারে আছে মাত্র ৪ লাখের মত। পাকিস্তানে ৩ লাখ পঞ্চাশ হাজার, সৌদি আরবে ১ লাখ ৯০ হাজার, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার, আরব আমিরাতে ৫০ হাজার, ভারতে ৪০ হাজার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১২ হাজার থাইল্যান্ডে ৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছে। এইভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত কী? বাংলাদেশের ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের ৪ লক্ষ রোহিঙ্গা বাদ দিলে বাকী প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যেতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। মিয়ানমারে ফেরত যেতে তাঁদের মধ্যে কোন তৎপরতা কী চোখে পড়ে?

বাংলদেশে শরণার্থী হিসেবে থাকা রোহিঙ্গারা বিশাল সমাবেশ করে বলেছে, তাঁদের শর্ত পূরণ না হলে তারা রাখাইনে ফেরত যাবে না। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাঁদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে, ফেরত নিতে হলে। মনে হচ্ছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশে ঘাড়ে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধী বিচারালয় রায় কি মিয়ানমার মানবে? এই অঞ্চলে বাংলাদেশ ছাড়া আর কেউ এর সদস্য নয়। ভারতও নয়, চীনও নয় এবং মিয়ানমারও নয়। তা হলে এই রায়ের কার্যকারীতা কতটুকু? আমেরিকাও এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয়। আমেরিকাও এই বিচার চায় না। কারণ মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের বিচার হলে, ইরাক এবং সিরিয়ায় গণহত্যার বিচারের দাবী উঠলে তাঁদেরকে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হবে। এই ব্যাপারে সোচ্চার শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ। চীন, ভারত, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে এই বিচার কতটুক গুরুত্ব বহন করবে, তা এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। একমাত্র ভরসা এসিয়ান জোটভূক্ত দেশসমূহ এবং চীন। এসিয়ান জোটভূক্ত রাষ্ট্রসমূহ কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তাও নিশ্চিত নয় । শুধু মাত্র চীনই পারে এর সমাধনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে। চীনের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক রূপ নিতে পারে নাই। এখন চীন কিসের বিনিময়ে রোহিঙ্গার সমস্যার সমাধান করবে? মিয়ানমারের সাথে চীনের সম্পর্ক এবং ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিনিময়ে? এই প্রশ্নের সামাধান এখনও কারো কাছে জানা নেই। (সমাপ্ত)

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট