চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাগদল থেকে বিএনপি : পথচলার ৪১ বছর

মোহাম্মদ এমরান

১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করে। তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান আর ঘাত-প্রতিঘাতে দেশে এক অনিশ্চয়তা নেমে আসে। এমন এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে আবির্ভাব ঘটে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় গণমানুষের অংশীদারিত্ব ও গণতন্ত্রায়নের জন্য ১৯৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় জাগদল। যার চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। জাগদল রাজনীতিতে সাড়া ফেলতে পারেনি। পরবর্তীতে জাগদল জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে রূপ নেয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠাতার লক্ষ্যে ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের একটি রূপরেখা দিয়েছেন। ‘৭৮ সালের ১ মে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হন জিয়াউর রহমান।

১৯৭৮ সালের ২৮ আগস্ট বিচারপতি সাত্তার ফ্রন্টের অন্যতম শরিক জাগদল বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে নতুন দলের অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। তৎকালীন মন্ত্রী অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নামে এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে বিএনপি’র ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি নামে নতুন দলের জন্ম হয়। জাগদলকে বিএনপির সাথে একীভূত করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মহাসচিব ছিলেন। বিএনপির লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্ব-নির্ভরতার উত্থান ঘটানো। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। ক্ষমতায় আসার পর সৈনিক জিয়া দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন। দেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেন। বিশ্ব দরবারে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তাঁর দল বিএনপি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনাসদস্যের গুলিতে শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৮৩ সালে সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি হন। দেশে সামরিক শাসন জারি করেন।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিতে বিপর্যয় নেমে আসে। ভাঙা-গড়া শুরু হয়। দলের কর্মী-নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে আসেন জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। পরে দলের চেয়ারম্যান হন তিনি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শুরু হয় এরশাদবিরোধী আন্দোলন। প্রায় ৯ বছর আন্দোলন করে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আন্দোলনের অগ্রভাবে ছিল খালেদা জিয়া। দেশবাসীর কাছে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পার করছে বিএনপি। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কয়েকজন দল ছেড়ে দেন। ১৯৮৩ সালে বিএনপি ভেঙে তিন ভাগ হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালে খালেদা জিয়া দলের হাল ধরার পর দুই ভাগ হয়ে যায়। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশের রাষ্ট্রপতি হন। পরবর্তীতে বিএনপি সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। তিনি বিএনপির একটি অংশ নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেন। ২০০৬ সালে অষ্টম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগের দিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের আরেকজন কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদ বীর বিক্রম বিএনপি ত্যাগ করেন। গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এল ডি পি)। ২০১২ সালে বিএনপি ছেড়ে আবুল কালাম আজাদ দলের একটি অংশ নিয়ে বিএনএফ গঠন করে। ঘাত-প্রতিঘাতের পরও বিএনপির জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরঞ্চ বেড়েছে। ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী রাষ্ট্র-ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দুই ছেলেও গ্রেপ্তার হন। দলের শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তারের পর দলের মধ্যে নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়। শীর্ষ অনেক নেতা খালেদা জিয়াকে জেলে বন্দী রেখে চেয়ারপারসনের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্ট করা হয়। সংস্কারের নামে একটি অংশ খালেদা জিয়াকে মাইনাস ফর্মূলার ছক করে। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা তা রুখে দেয়। ব্যর্থ হয় সংস্কারপন্থীরা।
এক-এগারোর পটভূমিতে অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে অপ্রস্তুত ছিল বিএনপি। তারপরও দেশ ও গণতন্ত্র অক্ষুণœ রাখতে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে এখনো ক্ষমতায় বাইরে গণমানুষের এই দলটি। ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লেও হারিয়ে যায়নি। ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে এখনো গণমানুষের আস্থায় অটুট রয়েছে।

লেখক : সদস্য, ফটিকছড়ি পৌরসভা বিএনপি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট